শাহবাগের খুন-মঞ্চের গান : প্রসঙ্গ চমক হাসান

By Mohammad Toha

 

"Unity is always effected by means of brutality; the union of northern France with the Midi was the result of massacres and terror lasting for the best part of the century. "

-Joseph Ernest Renan (1823-1892)

 

"The desire for an enemy, the desire for apartheid for separation and enclaving, the fantasy of extermination- all today occupy the space of this enchanted circle’

- Achille Mbembe, Necropolitics

 

১৮৮২ সালে,ফরাসি ঐতিহাসিক আর্নেস্ট রেঁনো তার জাতি কি বিখ্যাত বক্তৃতায় 'What is Nation? (Qu’est–ce qu’une nation?) জাতিরাষ্ট্রের উদয়কালে সহিংসার দিক চিহ্নিত করে, দেখান ঐক্য বর্বরতার মাধ্যমে প্রভাবিত হয়। উদাহরণ হিসাবে মিডি ও উত্তর ফ্রান্সের সহিংসতা-গনহত্যা - রক্তাক্ত ইতিহাস উত্তর সময়ের মিলন শনাক্ত করেন৷ রেঁনো দেখান উদয়কালে সেই রক্তাক্ত হিংস্রতা - বর্বরতা মানুষ ভুলে যায়। আমান্ডা মাচিন তার জাতীয়তাবাদ নিয়ে লেখায় রেঁনোর এই প্রস্তাবের উল্টো বিম্ব দেখতে পান বেনেডিক্ট এন্ডারসনের উছিলায়৷ বেনেডিক্ট এন্ডারসন তার কল্পিত সম্প্রদায় ( Imagined communities) বইয়ে দেখান, রেঁনো যে ভুলে যাবার কথা বলে,  কই ভুলে যায়? ভুলে যাওয়ার মিছে অভিনয় ত মনে করবার ই প্রচেষ্টা! এন্ডারসন বলেন, জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও তার বয়ানে এই ভুলে যাওয়াকে বরং  মনে করিয়ে দেয়, পারিবারিক ইতিহাস হিসাবে। তরিকুল হুদা তার "  সাম্য-মানবিক মর্যাদা তথা স্বাধীনতা ও গনতন্ত্রের হম্বিতম্বি, গালগপ্পোঃ শাহাবাগী লাশতন্ত্রের খতিয়ান" প্রবন্ধে রেঁনো - এন্ডারসনের শনাক্তি হতে দেখান কিভাবে ভুলে যাওয়া বা হঠাৎ মনে হওয়ার সাপেক্ষে এখানে প্রাসঙ্গিক আকারে হাজির হয় শত্রু চিহ্নিতকরণ ও তার নির্মূল করার সহিংস বাসনা। উত্তর - ঔপনিবেশিক ক্যামেরুনীয়  তাত্ত্বিক আশিলি এম্বেম্বে "The Society of Enmity " লেখায় দেখান, আইনি কাঠামোয় নাগরিক অধিকার ভোগ করার সমান্তারালে আরেক সমাজ আছে যেখানে নাগরিক হয়েও, জিন্দা লাশ হিসাবে থাকে। এম্বেম্বে দেখান, আগে এই জিন্দালাশের অন্তর্ভুক্ত ছিল নিগ্রো ও ইহুদি৷ বর্তমানে নিগ্রো ও ইহুদির স্থলে অন্য নামে যেমন : মুসলিম, ইসলামপন্থী, আরব, আদিবাসী,  অভিবাসী, নিম্নবর্গ ইত্যাদি জিন্দালাশ হিসাবে বেঁচে থাকে। নাগরিক - সাম্যের বুলি এইখানে বিহিত করতে  নাকামিয়াব৷ এম্বেম্বে একে 'The Terrifying Object " হিসাবে চিহ্নিত করেন। এম্বেম্বে Desire of Master এর সাথে  কল্পিত শত্রুর সাথে যে বাস্তবতার মিল নেই, তা নিশ্চিত করেন৷ এম্বেম্বে দেখান বাসনার পূর্ণতার জন্য কিভাবে কল্পিত শত্রুর ছবি আবিস্কারের নেশায় (Desire must continually invent it) মত্ত। এম্বেম্বে দেখান কিভাবে শত্রুর আকাঙ্ক্ষা, বিচ্ছিন্নতা, নির্মূল ও

ধ্বংসের কল্পনা- বৃহৎ বৃত্তের স্থান দখল করে নেয়।

 ২. রেঁনো - এন্ডারসন - এম্বেম্বের তত্ত্বীয় বিশ্লেষণের পূর্ণ রুপ ধরা দেয় শাহবাগ আন্দোলনে উৎপাদিত সাহিত্য - গান - চলচ্চিত্র - চরমপত্রে। আলোচনার সুবিধার জন্য শাহবাগ আন্দোলনে উৎপাদিত সাহিত্য, গান ইত্যাদির মধ্যে, দুইটি গানকে বেছে নিলাম। শুরুতেই বলে রাখা উত্তম যে, গান দুটির রচিয়তা, সুরকার, গায়ক, সহ অন্যান্য সহযোগী বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তথা বুয়েটের শিক্ষার্থী। তন্মধ্যে বিশেষ ভাবে চমক হাসান উল্লেখযোগ্য। চমক হাসান সহ এই গানে অংশ নিয়েছেন : দীপেশ দাশ, ফজলে রাব্বি, বহ্নি, টুনি, রীমা, সন্ধান, শোভন, শান্ত, সাবিহ, পিকুল, আহসান, ফয়সাল, পূষণ, জামির। উপরিক্ত ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে নিবন্ধের আগ্রহ শূন্যের কোটায়৷ গান দুটির পর্যালোচনা, বুয়েটিয়ানদের অরাজনৈতিক ভণিতায় খুনের রাজনীতিতে শরিক হবার ঠিকুজীর হদিস, সুক্ষ বর্ণবাদী মন, লাশ রাজনীতির প্রেক্ষিত সম্মতি দান তথা বৈধতার রাজনীতির সুলুকসন্ধান করা এই নিবন্ধের বাসনা৷  

যে দুটি গান নিয়ে আজকের এই পর্যালোচনা তার একটির নাম ফাঁসি, অপরটির নাম উত্তাল শাহবাগ। কথিত যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবিকে কেন্দ্র করে ফাঁসি নিয়ে গানটা প্রথমে জনপরিসরে আসে৷

"রাজাকার আল বদরেরা, নির্ভয়ে আজও ওরা .

যখন দর্পভরা বুকে সামনে হেঁটে যায়

তখন শোন পেতে কান তিরিশ লক্ষ শহীদ প্রাণ

কষ্টে দুঃখে হতাশায় গুমরে কাঁদে হায়

এক নদী রক্ত তবে গেল কি বৃথায় "

আর্নেস্ট রেঁনো যে বলছিলেন সহিংসা মানুষ ভুলে যায়, তা কিন্তু চমক হাসানের গানে দেখা যাচ্ছে না৷ বরং এন্ডারসনের বয়ানের উছিলায় বলতে পারি জাতীয়তাবাদী বয়ান - আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে চমক হাসান সহ বুয়েট শিক্ষার্থীরা সেই সহিংসতাকে পারিবারিক ইতিহাস হিসাবে মনে রেখেছে, যা তাদের  কল্পিত শত্রুকে যখন দেখে তখন তাদের মধ্যে অস্থিরতা ( Anxiety) তৈরি করে৷ এম্বেম্বে যেরুপ দেখান যে এই অস্থিরতা কল্পিত শত্রুকে নির্মূল করা অবধি শেষ হবে না৷ এম্বেম্বের এই শনাক্তি চমকের গানের অন্য চরণে উপস্থিত৷

"তোমার চোখের ভেতর যদি

বহে সে রক্তের নদী

যদি তোমার হৃদয়তলে

প্রতিশোধের আগুনজ্বলে

বজ্রকন্ঠে হুঙ্কারে বলো, 'আজ দাবি একটাই

এই মুহূর্তে সেই নরপশুদের ফাঁসি চাই'

অনেক সয়েছি লজ্জা গ্লানি আর তো সীমা নাই

এই মুহূর্তে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাই "

আশিলি এম্বেম্বে দেখান বাসনার পূর্ণতার জন্য কিভাবে কল্পিত শত্রুর ছবি আবিস্কারের নেশায় (Desire must continually invent it) মত্ত। এখানে চমকের গানে লাশ ফেলবার বাসনার পূর্ণতা দানের জন্য ছবি আবিস্কার, কল্পনার দিক স্পষ্ট। এম্বেম্বের শনাক্ত করা শত্রুর আকাঙ্ক্ষা, বিচ্ছিন্নতা, নির্মূল ও ধ্বংসের কল্পনার দিক চমকের গানে " প্রতিশোধের আগুনজ্বলে " " নরপশু "  "ফাঁসি চাই " শব্দে প্রতিফলিত হয়। কল্পিত শিশু হিসাবে ভ্রুন শিশু অবধি হাজির থাকে৷ বিনাশ - নির্মূল ই বাসনার পূর্ণতা দেয়৷ চমকের গানেও সেই দিক স্পষ্ট ভাবে ধরা দেয়৷ চমক "উত্তাল শাহবাগ " গানে বলেন :

"এই আমার মাটিতে বিষের ফসল আর নয় চাষাবাদ

তার শিকড় উপড়ে ফেলা অব্দি চলবেই প্রতিবাদ।"

চমকের দুই গানে মাটি তথা ভূমির প্রশ্ন সামনে আসে। যেমন "ফাঁসি চাই " গানে চমক বলেন :

" যাদের দ্বারা একাত্তরে নেমেছে অন্ধকার

এই মাটিতে ওদের আর নেইতো অধিকার"

মাটি তথা বাংলাদেশের ভূমি নিয়ে চমকের দুই গানে যে মূল্যায়ন দেখা যায়, তাতে বেশ কিছু ইশারা আছে আমাদের জন্য। একাত্তরে যারা অখন্ড পাকিস্তানের পক্ষে ছিল, তারা কোন মাটির সন্তান? পাকিস্তান রাষ্ট্র যখন তৈরি হল, তখন পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানের যে টেরিটরি। বাংলাদেশ হবার পর উপরিক্ত টেরিটরি ই বহাল ছিল৷ এই ভুমির সন্তানদের এক পক্ষ অখন্ড পাকিস্তান থেকে জুদা হয়ে যেতে চাইছে। অপর পক্ষ অখন্ডতা টিকিয়ে রাখতে চেয়েছে। উভয় পক্ষ ই যুদ্ধ করেছে। যুদ্ধে এক পক্ষ বিজয়ী হয়েছে। অপর পক্ষ পরাজিত। পরাজিত হয়েছে বলে তো, এই ভূমির উপর থেকে তাদের হক বা অধিকার নাই হয়ে যায় নাই৷ পরাজিত হবার পর পরাজয় মেনে নিয়ে বাংলাদেশ বাস্তবতায় নিজেদের মেলে ধরেছে। চমক হাসানের উল্লেখিত ভূমিতে অধিকারহীন প্রসঙ্গে দুটি নোকতা সত্য। এক, চমকের লাশতান্ত্রিক বাসনা (Necropolitical Desire) , দুসরা হলো, সাম্য- মানবিক মর্যাদা - নাগরিক অধিকারের যে গালগল্পো তা পরাজিতের জিন্দালাশের নিরাপত্তা বিধান করতে নাকামিয়াবি৷ চমক এখানে শুধু উগ্র বাঙালি  জাতীয়তাবাদী চিন্তার প্রতিনিধিত্ব করছে না। একই সাথে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের যে বুনিয়াদি লাশতান্ত্রিক কাঠামো তার উপসর্গ হিসাবে চিহ্নিত হয়। বিষয়টা এমন নয় যে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চিন্তার স্থলে সাম্য - মানবিক মর্যাদা, নাগরিক অধিকারের বললেই সমাধান হয়ে যাবে। চমক বাংলাদেশ ভূখন্ডের ঐতিহাসিক - রাজনৈতিক ঠিকুজী ধরতে পারে নাই৷ এখানে এই অঞ্চলের সেক্যুলারদের চিন্তার প্রতিনিধি মাত্র, যারা মনে করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম মানে দুই জাতি তত্ত্ব মিথ্যা হয়ে গেছে। এই চিন্তার পর্যালোচনা খোদ সেক্যুলার আইকন আবুল মনসুর আহমেদ করে গেছেন। আবুল মনসুর আহমেদ দেখান, কিভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্র লাহোর প্রস্তাবের পূর্ণ বাস্তবায়ন। চমক লাহোর প্রস্তাবের ঐতিহাসিক ঠিকুজী না সন্ধান করে লাশ রাজনীতিতে মত্ত ছিল।

চিন্তক ও রাজনীতি তাত্ত্বিক তরিকুল হুদা তার " সংহতি নাকি স্বৈরশাসন?  মীমাংসা নাকি সংঘাত?  ন্যাশনাল রিকন্সিলিয়েশনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ " শীর্ষক বক্তৃতায় বলেন, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ ভূমির ভিত্তিতে হবার দরুণ জাতীয় মীমাংসার শুরু করতে পেরেছিল শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসনআমলে৷ হুদা দেখান এই জাতীয় মীমাংসার ভিত্তি ছিল সংহতি ও অংশীদারিত্ব। এন্ডারসন যেমন দেখায় যে রাষ্ট্র এর উদয়কালে সহিংসতা মানুষ ভুলে না। সেই দিক আমলে নিয়ে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ জাতীয় মীমাংসার প্রস্তাব করে যাতে রাষ্ট্রে সকলকে নিয়ে পথচলা যায়। অথচ, বাংলাদেশের উদারনৈতিক প্রগতিশীল, মার্কসবাদী ধারার চিন্তক, আক্টিভিস্টরা শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের জাতীয় মীমাংসাকে মেনে নিতে পারে নাই। যার ফলাফল শাহবাগ। চমক হাসানেরা সেই চিন্তার প্রতিনিধিত্বকারী। চমক হাসানদের এখানে অরাজনৈতিক সুরুতে রাজনৈতিক হয়ে ওঠবার দিকটি চিন্তা উদ্দীপক। চমক হাসানের গানে পতাকা, প্রজন্ম চত্ত্বরের উপর মহিমা আরোপ দেখা যায়।

"এই পতাকার বুকে যতক্ষণ রবে সেই ক্ষতেরই দাগ

উত্তাল রবে এই 'প্রজন্ম চত্বর', শাহবাগ।"

 চমক হাসান এখানে রাষ্ট্রের ধর্মভাব বুঝতে পারেননি। জর্মান জুরিস্ট, আইন বিশেষজ্ঞ ও রাজনীতি তাত্ত্বিক কার্ল শ্মিট তার Political Theology তে দেখান আধুনিক রাষ্ট্র ও এর সার্বভৌমত্ত্ব এর প্রকল্প মুলত ধর্মনিরপেক্ষতার মোড়কে ধর্মতাত্ত্বিক প্রকল্প। চমক হাসান সহ অরাজনৈতিক বুয়েটিয়ান বর্গ  যখন রাষ্ট্র বিষয়ে পর্যালোচনা না করে, লাশ রাজনীতি করে তখন সেই ঘৃণা - খুনের বাসনার দেখা মেলে৷ চমকদের এই গান শাহবাগের যে লাশ রাজনীতি তাকে আরও উজ্জীবিত করে৷ খুনের শিকল তৈরি করে৷ শাহবাগের সময় বুয়েটেও শিবির সন্দেহে শরীলকে লাশ বানানোর রাজনীতি শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয় বিশেষ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য হয়ে উঠে ক্যাম্প। শিবির সন্দেহে যে লাশ রাজনীতি করবার পরে, সাধারণ শিক্ষার্থীদের বর্ণবাদের শিকার হতে হয়। ছাগু নামে ডাকা ছিল শাহবাগের কালচার৷ এম্বেম্বের ভাষায় বললে, ছাগু হচ্ছে শাহবাগের ন্যানো রেসিজম বা সুক্ষ বর্ণবাদ। বুয়েট শিক্ষার্থীদের এই লাশ রাজনীতি প্রায় গত এক দশক চলছে৷ চমক হাসানদের এই কল্পিত শত্রুর আবিষ্কার - কল্পনা - নির্মূল - বিনাশ - উচ্ছেদের লাশ রাজনীতির শিকার আবরার ফাহাদ৷ নিও রাজাকার, পাক শাবক ইত্যাদি ইত্যাদি পরিচয়ে এখনো সেই লাশ রাজনীতি চলমান।

৩.সম্প্রতি বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি ফেরানোর বিরুদ্ধে বুয়েট শিক্ষার্থীদের আন্দোলন বেশ আলোচিত৷ ০৭ ই অক্টোবর, ২০১৯ সালে বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে প্রগতিশীল সেক্যুলার ছাত্র সংগঠন ও ক্ষমতাশীল আওয়ামী লীগের লাঠিয়াল ছাত্রলীগ খুন করে৷ আবরার ফাহাদ খুনের পর বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়। নতুন করে ছাত্রলীগের রাজনীতি শুরু করবার বিরুদ্ধে সাধারণ শিক্ষার্থীরা আন্দোলন চালিয়ে যায়৷ সাধারণ শিক্ষার্থীদের অধিকাংশের দাবি, ছাত্র রাজনীতি ও র‍্যাগ কালচারের ই ফলাফল আবরার হত্যাকান্ড। আন্দোলন রত সাধারণ শিক্ষার্থীরা দেশের প্রধানমন্ত্রীর নিকট আকুল আবেদন জানিয়ে বলে, তারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী কিন্তু তারা ছাত্র রাজনীতি করতে আগ্রহী নয়। তারা প্রধানমন্ত্রীকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে, তারা প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়ন মুলক কাজ যেমন পদ্মাসেতু, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কাজ করে দেশসেবা করছে বা করবে। অপ-রাজনীতি তারা চায় না। ছাত্রলীগ তাদেরকে ছাত্র শিবির - হিযবুত তাহেরি বলে অভিযুক্ত করলে বুয়েট শিক্ষার্থীরা নিজেদের অরাজনৈতিক ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি দাবি করে। কেউ কেউ নয়া মিডিয়ার জনপরিসরে, তাদের পরিবারের সাথে আওয়ামী রেজিমের সম্পর্ক দেখায়৷ বুয়েট শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়ে বিবৃতি দেয় সাবেক শিক্ষার্থীরা। তারমধ্য অন্যতম চমক হাসান হাজির ছিলেন৷ নয়া মিডিয়ায় চমক হাসান পাবলিক পোস্টে বলেন,

"ডিপার্টমেন্টের প্রিয় জুনিয়র আবরারকে যে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল, মন থেকে সেই ক্ষত এখনও মুছে যায়নি। চেনা জুনিয়রদের সাথে যত আলাপ হয়েছে সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আবরার-হত্যার ঘটনার পর যখন ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়, তারপর থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা অনেক শান্তিতে ছিল, আছে। কোনো যুক্তিতেই আবার ঐ নরক ফিরিয়ে আনার মানে হয় না।"

চমক হাসানের গানের লাশতন্ত্র কায়েমের যে বাসনা ছিল, তার শিকার আবরার ফাহাদ। আবরার কে শিবির সন্দেহে খুন করা হয়। এ কথা চমক গুম করে দিয়ে যেভাবে উল্লেখ করলেন, সেখানে মনে হয় ক্যাম্পাসের রাজনৈতিক সহিংসতা - র‍্যাগিং কালচার ই দায়ী। আর এসব কিছুর মূল হোতা ছাত্র সংগঠন গুলোর ছাত্র রাজনীতি। লাশতন্ত্র (Necropolitics)  এবং ক্যাম্পাসের রাজনৈতিক সহিংসতা ( Political Violence) কে চমক অজ্ঞানে হোক বা সজ্ঞানে একাকার করে ফেলেছে। শিবির সন্দেহে বুয়েটের ছাত্র  পিটিয়ে মারা হয়নি শুধু, বুয়েট শিক্ষক কেও সংঘবদ্ধ ভাবে মারধর করা হয়েছে। এই মারধরের বৈধতা দিয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থী নামের সুযোগসন্ধানী মব।

কার্ল মার্ক্স ইতিহাসের পুনঃ উৎপাদন নিয়ে বলেছিলেন যে, প্রথমে তা হাজির হয় ট্রাজেডি হিসাবে ; পরে হাজির কমেডি হিসাবে৷ সম্প্রতি বুয়েট শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সাথে জড়িতদের শিবির - হিযবুত তাহেরি বলে ট্যাগিং করা হয়। ট্যাগ খেয়ে এরা নিজেদের পরিবারে কে মুক্তিযোদ্ধা বা কে আওয়ামী লীগের লোক তা প্রমানে ব্যস্ত হয়ে পরে৷ যেকোনো ট্যাগিং পলিটিক্সের বিরুদ্ধে অবশ্যই বলতে হবে। কিন্তু এখানে একটা বিষয় জড়িত। শিবির - হিযবুত তাহেরি ট্যাগ দেওয়ার পর যখন সাধারণ শিক্ষার্থীরা ওয়ার টেররের লজিকের গুড মুসলিমের মতোন শাহবাগের লজিক অনুযায়ী অরাজনৈতিক শিক্ষার্থী হয়ে যায়। জর্মান দেশে টোটালিটারিয়ান রেজিমের সময় জর্মান - ইহুদি রাজনৈতিক দার্শনিক হানা আরেন্ড বলেন, কেউ যদি নাজি জার্মানিতে ইহুদি হিসাবে আক্রান্ত হয়, তাকে অবশ্যই নিজেকে ইহুদি হিসাবেই নিজকে রক্ষা করতে হবে ; জার্মান বা বিশ্ব নাগরিক হিসাবে নয়। বুয়েট সাধারণ শিক্ষার্থীরা শাহবাগের লজিক অনুযায়ী নিজেদের আত্মবিরোধী করে তোলে।  

শাহবাগের লাশ রাজনীতিতে বুয়েট শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ, কার্যক্রম ইত্যাদি ইত্যাদি অরাজনৈতিক বাতাবরণে হয়েছে। অরাজনৈতিক সাধারণ শিক্ষার্থী শাহবাগ থেকে আজ অবধি ওয়ার অন টেরর, ইসলামোফোবিয়া, সুক্ষ বর্ণবাদ, নির্মূলের রাজনীতির অংশীদার। শাহবাগের যে নির্মূল - বিনাশ - উচ্ছেদ তথা লাশতন্ত্র এর খতিয়ান হতে চমক হাসান তার সহযোগী বা বিশেষত অরাজনৈতিক সুরুতে সাধারণ বুয়েট শিক্ষার্থী দায় এড়াবে কিভাবে? অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ হয়? 

কৃতজ্ঞতা স্কীকার : এই নিবন্ধ লিখবার পিছনে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে তরিকুল হুদা, তানজিন দোহা ও

আব্দুর রহমান বারি। আব্দুর রহমান বারি বেশ কিছু দিক সম্পাদনা করে দিয়েছে, তাকে ধন্যবাদ জানাই। লেখাটা শাপলায় শহিদ হওয়া বুয়েট শিক্ষার্থী শহিদ রোহান এবং শহিদ আরবার ফাহাদকে উৎসর্গ করছি।

বরাত :

১. Joseph, Ernest Renan. What is a Nation?

https://fee.org/articles/what-is-a-nation/

২. Benedict Anderson. Imagined Communities: Reflections on the Origin and Spread of Nationalism.

৩. Mbembe, Achille, Necropolitics, translated Steven Corcoran, Duke University press, 2019

৪.https://www.milestonesjournal.net/shapla-10-year-anniversary-1/2024/1/15/-

৫.https://www.somoynews.tv/news/2024-04-01/v0yIuu08

৬.https://youtu.be/aD7vQTlUWYg?si=csUbY-n5TDn_aOC2

৭. যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে চমকের গান " ফাঁসি চাই "।  

অনেক সয়েছি লজ্জা গ্লানি আর তো সীমা নাই

এই মুহূর্তে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাই

যাদের দ্বারা একাত্তরে নেমেছে অন্ধকার

এই মাটিতে ওদের আর নেইতো অধিকার

আমার মায়ের সে কষ্টগুলো আজও মেটে নি, তাই

সারা পৃথিবী এক হয়ে সে কলঙ্ক মুছতে চাই

অনেক সয়েছি লজ্জা গ্লানি আর তো সীমা নাই

এই মুহূর্তে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাই

রাজাকার আল বদরেরা, নির্ভয়ে আজও ওরা .

যখন দর্পভরা বুকে সামনে হেঁটে যায়

তখন শোন পেতে কান তিরিশ লক্ষ শহীদ প্রাণ

কষ্টে দুঃখে হতাশায় গুমরে কাঁদে হায়

এক নদী রক্ত তবে গেল কি বৃথায়

না-না-না-না-না

তোমার চোখের ভেতর যদি

বহে সে রক্তের নদী

যদি তোমার হৃদয়তলে

প্রতিশোধের আগুনজ্বলে

বজ্রকন্ঠে হুঙ্কারে বলো, 'আজ দাবি একটাই

এই মুহূর্তে সেই নরপশুদের ফাঁসি চাই'

অনেক সয়েছি লজ্জা গ্লানি আর তো সীমা নাই

এই মুহূর্তে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি চাই

কথা,সুরঃ চমক হাসান

গিটারঃ ফজলে রাব্বি

চিত্রগ্রহণঃ ইফতেখার হোসেন শোভন

কণ্ঠঃ চমক,দীপেশ,পিকুল,আহসান,ফয়সাল, শান্ত,সাকিব,বহ্নি, টুনি, রীমা, পূষণ, জামির

কৃতজ্ঞতাঃ ইউনিভার্সিটি অফ সাউথ ক্যারোলাইনার সমমনা সমস্ত মানুষ।

৮. উত্তাল শাহবাগ (A new song from Chamok, Rabbi & Friends 

এই পতাকার বুকে যতক্ষণ রবে সেই ক্ষতেরই দাগ

উত্তাল রবে এই 'প্রজন্ম চত্বর', শাহবাগ।

রাজপথ ছাড়ি নি, ছাড়বে না তো কেউ

থামবে না কিছুতেই এই গণজোয়ারের ঢেউ।

সব নরকের কীট পৃথিবীর বুকে শ্বাস নেবে যতকাল

ফাঁসির দাবিতে ক্ষুব্ধ জনতা রইবে উন্মাতাল

এই আমার মাটিতে বিষের ফসল আর নয় চাষাবাদ

তার শিকড় উপড়ে ফেলা অব্দি চলবেই প্রতিবাদ।

এই পতাকার----- শাহবাগ 

দেখ মলিন শাড়িতে এসেছে এক সন্তানহারা মা

দাউ দাউ করে চোখের ভেতর জ্বলছে তার ঘৃণা

এক বিচার দেখতে এতটা বছর তার বেঁচে থাকা

কিছু নরপিশাচের মৃত্যুস্বপ্ন দুই চোখে আঁকা

এসেছে পিতাহারা সন্তান আর সব হারা বোন

আজও জেগে ওঠে দুঃস্বপ্নে সেই নির্যাতন

এই বহু বছরের জমানো ব্যথার, এল সময় হিসেব মেটাবার

আজ অতন্দ্র প্রহরীর মতো পুরো জাতি সজাগ

এই পতাকার বুকে যতক্ষণ রবে সেই ক্ষতেরই দাগ

উত্তাল রবে এই 'প্রজন্ম চত্বর', শাহবাগ।

কথাঃ চমক হাসান,

সুরঃ চমক হাসান, দীপেশ দাশ

গিটারঃ ফজলে রাব্বি

কণ্ঠঃ চমক,দীপেশ,বহ্নি, টুনি, রীমা, সন্ধান, শোভন, শান্ত, সাবিহ