Image edited by Paul Hoi

Razakarnama: Organic Crisis and Secular Necropolitics

শাপলা-উত্তর বাংলাদেশে জুলাই, ঈসায়ী ২৪ এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ৷ সরকারি চাকুরীতে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের ৩০ শতাংশ কোটা প্রথার বিরোধিতা লইয়া বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের যাত্রা। ফ্যাসিবাদী - অগণতান্ত্রিক - লুটেরা - মাফিয়া রেজিমের হর্তাকর্তা আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের ' রাজাকার' বলে। শিক্ষার্থীরা রাতে " তুমি কে, আমি কে?  রাজাকার, রাজাকার স্লোগান দিয়ে রাস্তায় নামেন৷ পরদিবস কারবালায় রক্তাক্ত হয় বাংলাদেশ, যা জুলাই গনহত্যা সমেত,  চলতি গুম-খুন-গ্রেফতারে এখনো বহাল। শুরুতে আমি কে, তুমি কে?  'রাজাকার, রাজাকার' স্লোগান থাকলেও, পরে এখানে কে বলেছে, কে বলেছে? 'স্বৈরাচার, স্বৈরাচার' স্লোগান তালি দিয়ে জুড়ে দেওয়া হয়। নব্বইয়ের দশকে উৎপাদিত "তুই রাজাকার " হইতে চলতি "আমি রাজাকার " এর সর্বনামের বাঁক বদল বাংলাদেশ রাষ্ট্রের হৃদরোগের লক্ষণ মাত্র। রোগ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বুনিয়াদে৷

ফরাশি মহাত্মা আর্নেস্ট রেঁনো তার জাতি কি রচনায়, জাতিরাষ্ট্রের উদয় কালে প্রানঘাতী সহিংসা শনাক্ত করেন৷ রেঁনোর দাবি উদয়ের সেই রক্তাক্ত খুনে নৃশংসতা একসময় ভুলে যায় মানুষ। রেঁনোর দাবির ব্যবচ্ছেদ করেন বেনেডিক্ট এন্ডারসন। গোসাঈ, কই ভূলে যায়? এই যে মানুষ দুঃসহ সেই নৃশংসতাকে ভুলতে চায়, তা আসলে মনে করারই নামান্তর। উল্টিয়ে বললে, যা কিছু মনে রাখলে আমরা আত্মবিরোধে উপনীত হই, তাকেই আসলে আমরা ভুলতে চাই। এখানেই ভুলে যাওয়া আর মনে রাখা মিলিত হয়ে পরে একই বিন্দুতে। এখানেই প্রাসঙ্গিক হয়ে আসে সেই ‘শত্রু’কে চিনে রাখা,  যাকে নির্মুল করার সহিংস বাসনা এবং সক্রিয়তা এই জাতীয়তাবাদী সেক্যুলার কর্তাসত্ত্বাকে মূর্ত করে তোলে। ভয়ঙ্করতম এই কাল্পনিক শত্রুর মোকাবেলা করাই একমাত্র নিয়তি হয়ে দাঁড়ায় জাতির। এই তথাকথিত শত্রু এতই ভয়ঙ্কর যে তার বিনাশ না হওয়া মানে নিজের বিনাশ হওয়া। লাশ ফেলার কর্তা বারবার সতর্ক, অস্থির (Anxiety) থাকে নিজের অপরিপূর্ন অস্তিত্ত্বকে টিকিয়ে রাখতে। নিজ অস্তিত্ত্বের ঠাহর নিজেই করে আর পেরে উঠে না সে। সে তার আমিত্ত্বকে পরিপূর্ন হিসাবে দেখতে পায় নাই। অপূর্ন থাকে। সেই অপূর্নতা পূর্ন করলেই যেন তার আমিত্ত বা ইগো পরিপূর্ন হতে পারে।

এই পর্যায়ে সে এমন ভয়ঙ্কর কোন কিছু (এই দিককে আশিলি এম্বেম্বে ‘The terrifying object’ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন) বলে কল্পনা করে বসে, যার বিনাশ সাধন করার বাসনা দিয়ে নিজের অসম্পূর্ন অস্তিত্ত্বকে পরিপূর্ন করার কল্পনা করা যেতে পারে। তবে কল্পলোকের এমন শত্রুর অস্তিত্ত্ব বাস্তবের সাথে মিলে না। বাস্তবতার সাথে যদি খুনীর লাশ ফেলার গ্রহনযোগ্যতার সম্পর্ক না থাকে, তাহলে খুন কারো কাছে গ্রহনযোগ্য হবে না, লাশ ফেলার যৌক্তিকতা দেওয়া যাবে না। তাই বিকট নৃশংস শত্রুর ছবি এঁকে সে নিজের কল্পনাকে সাজায়। শত্রুকে এমন ভয়ঙ্করতম ভাবে সাজানোর কল্পনা করার প্রক্রিয়া এতই শক্তিশালী যে, এই বাসনা খুনীর চারপাশে খুন করে লাশ ফেলে দেওয়ার স্থানিক আবহ তৈরি করে, যেই অবস্থানে বা জায়গায় খুনীরা খুনের সাফাই গায়, খুনীদের সাথে মিলিত হয়, নতুন খুনী তৈরি করতে থাকে। তৈরি হয় খুনী ভ্রাতৃত্ব। এই স্থানে পৌনঃপুনিকভাবে তৈরি হতে থাকে খুনের গল্প,শত্রুর কল্পনা। কখনো সে সামন্তমনা, সাম্প্রদায়িক, কখনো স্বাধীনতা বিরোধী, কখনো রাজাজার, কখনো ধর্ম নিরপেক্ষতার শত্রু, যুদ্ধপরাধী, জাতিবাদী, পরিচয়বাদী, কখনো বা জঙ্গী, জামায়াত-শিবির বা হেফাজতি।  

ইসায়ী ২০১৩,  শাহাবাগের ব্যস্ত মোড় এমনই এক তাৎপর্যময় স্থান হিসাবে দাঁড়িয়ে যায়। অপরদিকে খুব কাছেই শাপলা চত্বর হয়ে দাঁড়ায় এমন স্থান, যা বদ্ধ ভূমি, ফাঁসীর মঞ্চ বা ফায়ারিং গ্রাউন্ডের মতো বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। দিনের পর দিন ধরে চলতে থাকে শাহাবাগ গনজাগরন মঞ্চ পুলিশী পাহাড়ায়, অথচ শাপলা চত্বর বধ্যভূমির জন্যে বরাদ্দ সময় ২৪ ঘন্টাও পার হতে পারে না। শাপলা নামের বিশেষ এই স্থান থেকে বিদ্যুৎ-আলো বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। খতমের উৎসবের পরে মিনিসুপালিটির পানির গাড়ী ব্যবহার করে পরিস্কার করে ফেলা হয় রক্তের দাগ। অপরদিকে খুন হওয়া রক্তাক্ত আলেমদের লাশ নিয়ে মশকারি করে দেখানো হয়, পালানোর অপেক্ষায় রঙ মেখে শুয়ে থাকা অথর্ব মানুষ হিসাবে। যখন যেভাবে জনগনকে খাওয়ানো যায়, সেভাবে বারবার একই শত্রুর কাল্পনিক নির্মান আর তাকে ঘায়েল করার খুনে জিঘাংসা তৈরি চলমান থাকে ধর্মনিরপেক্ষ সাম্যভিত্তিক লাশতন্ত্রে।

অবিরত ভাবে দিনের পর দিন চলতে থাকে স্বাধীনতার শত্রু মিত্র নিয়ে দেশবাসীকে ভাগ করার চেষ্টা । সমাজের অভ্যন্তরে এসব নিয়ে মাথাব্যথা প্রায় সম্পূর্ন উবে গেলেও, নির্দিস্ট খুনে রাজনৈতিক গোষ্ঠী এই ঘৃনার পূনরুৎপাদন করতে থাকে লাশ ফেলার উছিলায়। রাজাকার - শিবির খুন করবার পরে চলে বৈধতার রাজনীতি। কখনো মৃদু সুরে আধুনিক রিপাবলিকের নাগরিক অধিকারের আলাপ তুললেও, তা নাগরিক সাম্য বিহিত করতে নাকামিয়াব। তাহলে দেখা যাচ্ছে, শিক্ষার্থীদের রাজাকার স্লোগান হঠাৎ আসমান হতে নাজেল হয় নাই। নিছক অভিমান অথবা ক্ষোভে বলবার শিশুসুলভ অর্থ তৈরিও ধোপে টিকে না। "আমি রাজাকার "  বলবার পর যে গনহত্যা হলো তার সাথে ঐতিহাসিক রিশতায় সম্পর্কিত শাপলা গনহত্যা৷ রাজাকার কে? তার অস্তিত্বময়তা (Dasein) কি,  রাজাকারের কর্তাসত্ত্বা (Subjectivity)  কি? এই প্রশ্ন উপেক্ষা করে গুড সেক্যুলার মহল নিয়ন্ত্রণমূলক বা ডিসিপ্লিনারি ক্ষমতার কারিগরি ব্যবহার করে চলমান আন্দোলন এবং শহিদদের প্রতি জ্ঞানতাত্ত্বিক সহিংসতায় ( Epistemic Violence)  লিপ্ত৷  ফলে তারা রোগকে চিহ্নিত করতে না পেরে, তাতেই কল্যাণের সন্ধান করছেন।

আমরা পর্যায়ক্রমে চলমান আন্দোলন, লাশতান্ত্রিক ক্ষমতার বিরুদ্ধে গাযার প্রতিরোধ যোদ্ধাদের ন্যায় গণপ্রতিরোধ, এর ঠিকুজি - ভাষা - রাজনৈতিকতা -  বাসনা ও সংহতির বুনিয়াদে শরিকানা ও ঐক্যের রাজনীতি বিচার করব৷ কবিতা, প্রবন্ধ, স্মৃতিচারণ, ভিজ্যুয়াল প্রবন্ধ, সাক্ষাৎকার, পডকাস্ট ইত্যাদির উছিলায় চলমান দশার প্রতিফলন করতে চেষ্টা করব৷ আপনাদের সক্রিয়তা ও লিপ্ততা কাম্য।