শাহবাগের বয়ানে ইসলাম

By Athar Ali

 

একাত্তর বা স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে শাহবাগ আন্দোলন এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ। এই ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ নিয়ে নানা মাত্রায় পাঠ, পর্যালোচনা, বাহাস - বাতচিত  হাজিরা দিয়েছে, দিচ্ছে বা অনাগত সময়েও দিবে। শাহবাগ আন্দোলনের অবয়ব বা মোড়কের ( Appearance) সুরুত দেখে,এর মর্মের পূর্বানুমান করা হয় ; যার ফলে শাহবাগ বা শাহবাগি ইত্যাদি বর্গ গুলো আম আদমি গালি হিসাবে ব্যবহার করে। এই ব্যবহারের সুফল - কুফলের খতিয়ান বের করা এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য নয়৷ শাহবাগ সংক্রান্ত বাজারি পাঠ-বাহাসে শাহবাগকে "নাস্তিকতা " " বেহায়াপনা " " বিচারহীনতা " "সাংস্কৃতিক যুদ্ধ "  "সাংস্কৃতিক বাইনারি " " শাহবাগ = আওয়ামী লীগ " ইত্যাদি ইত্যাদি বর্গয়ান ও সংজ্ঞায়ন করা হয়। এই বর্গায়ন ও সংজ্ঞায়ন যে পুরো মিথ্যা নয়, তা নিশ্চিত না করলে ; উক্ত বাজারি পাঠের অতল গহব্বরে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভবনা প্রকট৷ এই পাঠ - পর্যালোচনা অংশত সত্য৷ তবে পুরো সত্য নয়৷ এজন্য, এই বাজারি পাঠকে অবয়ব হিসাবে শনাক্ত করছি৷ এই নিবন্ধে শাহবাগের " ইসলাম "  চিন্তা,  "উলেমা " বিশেষত দেওবন্দী ধারার সাথে তাদের রাজনৈতিক ও বাসনাগত ঐক্যের সুর আলোচিত হবে৷ শাহবাগের বয়ানে ইসলাম এমন এক পরিসর নিয়ে হাজির হতে যাচ্ছে, যা শাহবাগের সামষ্টিক দিককে ছাপিয়ে মর্মের সুলুকসন্ধান করবে৷ সামষ্টিকের বদলে ব্যষ্টিক দিকের দিকে নজর দেওয়া ই উক্ত নিবন্ধের বাসনা৷

১.  শাহবাগের সাথে ইসলামের সম্পর্ক বিচার করার মুছিবত হচ্ছে, উক্ত বিচারকে বাছ-বিচারি কায়দায় দেখবার সুযোগ হয়ে ওঠে না৷ সাধারণত, শাহবাগ ছিল কথিত যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবিকে কেন্দ্র করে ; গভীরে গিয়ে আরেকটু বাড়িয়ে বললে ইসলামপন্থা তথা ইসলামের রাজনৈতিকতা নির্মূলের অভিপ্রায়। প্রসঙ্গক্রমে প্রশ্ন আসে, ইসলামপন্থা কাহারে কয়? খিলাফত উত্তর দুনিয়ায় আধুনিক রাষ্ট্রে ইসলামকে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক উপায়ে কর্তা (Subject)  হিসাবে হাজির করা আধুনিক ইসলামপন্থার বাসনা। খিলাফত উত্তর দুনিয়ায় নব্য তুরস্কে আইনি বলে ইসলামকে জোরপূর্বক উচ্ছেদ করা হয়। মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের এই নীতি যা অধ্যাপক সালমান স্যায়িদ বর্গায়ন করেন কামালবাদ ( kemalism)  নামে ; তা মুসলিম জাহানের নানা ভূখন্ডে প্রভাবিত করে৷ ইরানের রেজা শাহ পাহলভী, আফগানিস্তানের আমানউল্লাহ, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ণ সহ নানা ভূখন্ডের শাসক ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণী  প্রভাবিত হয়। আধুনিক ইসলামপন্থা বিকশিত হয় মিশরীয় ইমাম হাসান আল বান্নার হাত ধরে, যা পরে জর্ডান - লেবানন, তুরস্ক, সিরিয়া, মিশর, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, মরক্কো সহ আরব রাষ্ট্রে ছড়িয়ে পরে৷ ঔপনিবেশিক সময়ে ইসলামপন্থার উপনিবেশ বিরোধী সংগ্রাম দেখা যায় এশীয়-আফ্রিকায়৷ ঔপনিবেশিক যামায় দক্ষিণ এশিয়ায় আধুনিক ইসলামপন্থা বিকশিত হয় মাওলানা মাওদুদির হাত ধরে৷ সালমান স্যায়িদ দেখান ইসলামপন্থা ইসলামকে " Master Signifier " হিসাবে হাজির করে। আধুনিক ইসলামপন্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক ক্ষমতা। মাওলানা মাওদুদির হাত ধরে দক্ষিণ এশিয়ায় বিকশিত ইসলামপন্থী রাজনৈতিক সংগঠন জামাতে ইসলামী। আধুনিক ইসলামপন্থা দক্ষিণ এশিয়ায় জামাত বা আরব-মাগরিবে ইখওয়ানের সাথে মুলত ইসলামের ঐতিহ্যে বা তুরাস ( Tradition) এর সাপেক্ষে বৈরি সম্পর্ক দেখা যায় আরবে সালাফি-ওয়াহাবি বা এদের উপধারাতে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় প্রধানত দেওবন্দী ধারার সাথে। যদিও জামাতে ইসলামের শুরুতে বেশ কিছু  দেওবন্দী ছিলেন৷ পরে তারা পদত্যাগ করেন৷ দেওবন্দী বনাম জামাত বা বিশেষত মাওদুদির এই বাহাস-মুনাজারা ঐতিহাসিক ভাবে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। ইলমি ইখতিলাফ ( Critique)  চলেছে। দেওবন্দীদের প্রধান অভিযোগের কেন্দ্র মাওলানা মাওদুদির ইতিহাস পাঠ বিশেষত আমিরে মুয়াবিয়া (রা :) সহ সাহাবা সংক্রান্ত  চিন্তা, কুরআনের চারটি পরিভাষা ইত্যাদি নিয়ে৷ এর জবাব নানা সময়েও হাজির হয়েছে। কখনো আবুল হাসান আলি নদভি, মাওলানা তাকি উসমানি, মাওলানা মনযূর নোমানি বা মাওলানা জাফর আহমদ উসমানি বা মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানি এর পর্যালোচনা হাজির করেছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, আধুনিক ইসলামপন্থা বিশেষত দক্ষিণ এশিয়ায় মাওলানা মাওদুদির সাথে ট্রাডিশনাল উলেমা বিশেষত দেওবন্দীদের সংঘাত বেশ পুরানো।

শাহবাগ আন্দোলনে আধুনিক ইসলামপন্থা বিশেষত মাওলানার মাওদুদির বিরুদ্ধে দেওবন্দীদের এই সকল পর্যালোচনা নিমূর্লের রাজনীতি প্রকল্পে হাজির হইল৷ প্রশ্ন হতে পারে, জ্ঞান বা এর পর্যালোচনা কে ও কিভাবে ব্যবহার করছে তা বিবেচনা করা জ্ঞান উৎপাদন কারীর বিষয় নহে। এজন্য সত্যকে কবর দিতে হবে? উত্তর হচ্ছে না। পর্যালোচনা ত দীর্ঘদিন চলেছে, ভবিষ্যতেও চলবে। তা থেমে থাকবে কেন!তা নিয়ে নিবন্ধের আগ্রহ শুন্যের কোটায়। কিন্তু যখন পর্যালোচনা নিমূর্লের রাজনীতি প্রকল্পে হাজির হয়, তা নিয়ে আলাপের অবকাশ আছে বৈকি।

মুহাম্মদ তাসনিম আলম তার "ইসলাম ও জামাতে ইসলাম : প্রেক্ষিত শাহবাগ আন্দোলন " নিবন্ধে দেওবন্দীদের সাথে জামাতে ইসলামীর; বিশেষত মাওদুদির বিরোধকে হাজির করে। তাসনিম আলম দেওবন্দী আকাবিরদের পর্যালোচনা হাজির করে দেখান, শাহবাগ মাওদুদিবাদের বিরোধিতা করে ; ইসলামের বিরোধিতা করে না৷ শাহবাগকে বেহায়াপনা ও নাস্তিক্যবাদের সাথে মিলিয়ে পাঠ বা হাজির করাকে তাসনিম প্রোপাগাণ্ডা ও মতলববাজি হিসাবে চিহ্নিত করেন৷

"গুটিকয় ব্যক্তির নোংরা ইসলামবিদ্বেষের সাথে এই আন্দোলনকে গুলিয়ে ফেলার কোন অবকাশ নাই। "

তাসনিম আলমের বয়ানে শাহবাগ আন্দোলন ইসলামকে রক্ষা করছে। তাসনিম আলম আরও দেখান সাহাবায়ে কেরাম বিদ্ধেষী, বিকৃত-মডারেট, ক্ষমতালোভী জামাতে ইসলামীকে বয়কট করা ইমানি দায়িত্ব। শাহবাগের সাথে ইমানি দায়িত্বের সম্পর্কের দিকটা শাহবাগের সংক্রান্ত নাস্তিক্যবাদী-  বেয়াহায়াপনার যে বাজারি বয়ান তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তাসনিম ধার্মিক মুসলিমের ন্যায় হতাশ না হয়ে বলেন, তাদের কাজ চেষ্টা করা৷ আখেরে, ইসলামকে হেফাজত আল্লাহ ই করবেন।  

" এদের ছোবল থেকে ইসলামকে রক্ষা করুন। এটা প্রত্যেক মুসলমান নরনারীর ইমানি কর্তব্য। বান্দার দায়িত্ব সাধ্যমত চেষ্টা করা। কেননা, চূড়ান্তভাবে ইসলামকে হেফজতের দায়িত্ব নিয়েছেন স্বয়ং রাব্বুল আ’লামিন। জয়তু শাহবাগ! "  

তাসনিম আলমের বরাতে শাহবাগের বয়ানে ইসলামের যে সম্পর্ক হাজিরা দেয়, তা আগ্রহ উদ্দীপক। বাজারি শাহবাগ পাঠে নাস্তিক্যবাদী বয়ান নজরে পড়ে ৷ উল্টো, এই শাহবাগ মাওদুদিবাদের বিরুদ্ধে, রাসুল সা: তার সাহাবায়ে কেরামের পক্ষে। তাসনিম আলমের উছিলায় এমন শাহবাগ উঁকি দেয় যা ইমানি দায়িত্ব পালনে রত। শাহবাগের প্রায় এক যুগ পরে শাহবাগের সাথে ইমানি দায়িত্বের সম্পর্ক শুনলে অট্টহাসি পেয়ে বসবে হয়তো৷ কিন্তু শাহবাগ আন্দোলনে এমন কিছু দিকের আলামত তখনকার বাস্তবতাতেও শনাক্ত হয়েছিল৷ যদিও সেসব প্রবণতার পর্যালোচনামূলক ঢংয়ে না নিয়ে, বরং নিউ মিডিয়ায় হাসি-সহিংসতা ঘটে!

২.  তাসনিম আলমের বরাতে শাহবাগের বয়ানে ইসলামের নানা মাত্রার প্রবণতা শনাক্তি করবার পরেও, পর্যালোচনার অংশ হিসেবে দেওবন্দী আলেম মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদের শাহবাগ আন্দোলনে যোগদানকে নমুনা হিসাবে নিতে পারি৷ শুধু তাসনিম আলমের দোহাই দিয়ে বললে, তাকে সেক্যুলার সুযোগ সন্ধানী হিসাবি চিত্রায়িত করার সম্ভবনা প্রকট। দেওবন্দ ফেরত মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ মাদানি ধারার আলেম হিসাবে অধিক পরিচিত। মাদানি ধারার আলেম বলতে মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানির সিলসিলার অংশ। মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানি ভারতীয় আলেম হলেও, শাহবাগ আন্দোলনে তার চিন্তা - সিলসিলা প্রচ্ছন্ন প্রভাব রাখে৷ ১৯৪৭ সালের আগে হিন্দু - মুসলিম এক জাতি তত্ত্ব হাজির করেন  মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানি। ভারতীয় কংগ্রেসের সাথে তার রাজনৈতিক ঐক্য এবং  না-পাকিস্তান তত্ত্বায়নের মাধ্যমে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধী ছিলেন৷ যদিও দেওবন্দের আরেক ধারা বিশেষত হাকিমুল উম্মাত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী এবং তার অনুসারীরা মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানির চিন্তার অন্তঃসারশূন্যতা তুলে ধরেন৷ এক জাতি তত্ত্বের পর্যালোচনা করে, দুই জাতি তত্ত্বের ইসলামিক ব্যখ্যা তুলে ধরেন কোরান, হাদীস, ফিকাহ ও আকাবিরে দেওবন্দের সিলসিলা হতে। মাওলানা মাদানি ধারার উলেমা " পাকিস্তান " " মুসলিম লীগ " "জামাতে ইসলামী "  এদের অপছন্দ করত, বা কিছু জায়গায় বিদ্ধেষ রাখত। তারা এটাকে দীনি গাইরত হিসাবে প্রচার করত। হেফাজতে ইসলাম প্রতিষ্ঠা হবার পর ২০১১ সালে এই অঞ্চলে মাদানি ধারার খলিফা মাওলানা আহমদ শফির সাক্ষাৎকার নেন বুদ্ধিজীবী ও কবি মাওলানা মুসা আল হাফিজ। উক্ত সাক্ষাৎকারে যখন প্রশ্ন করা হয় আলেম দের মাঝে যারা জামাতে ইসলামীর সাথে সম্পর্ক উঞ্চ করছে তাদের নিয়ে তার অভিমত কি? উত্তরে মাওলানা আহমদ শফি উল্লেখ করেন, মাওদুদি এবং জামাতের বিষয়ে বিদ্ধেষ রাখাকে সে দীনি গাইরতের অংশ মনে করেন।

" তাদের মনে রাখা উচিত, আওয়ামীলীগ স্বার্থ ফুরালে কেটে পড়ে। কিন্তু জামাত স্বার্থ ফুরালে কেটে ফেলে ।মওদুদী জামাতের প্রতি ঘৃণাপোষণ করাকে আমি দ্বীনি গায়রাতের অংশ মনে করি।"

মাদানি ধারার আলেম জামাতে ইসলামী, মাওদুদি বিষয়ে যে ঘৃণাপোষণ করে তার ঐতিহাসিক দিককে আমলে না নিলে, এর কুলুজির হদিস না করলে মাওলানা আহমদ শফির উক্ত মন্তব্যে শুধু প্রতিক্রিয়া হবে, পর্যালোচনা হবে না। জামাত, মাওদুদির প্রতি ঘৃণাপোষণ করা যেখানে দীনি গাইরত, সেখানে মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ দীনি গাইরতের উদাহরণ তৈরি করলেন শাহবাগে খোদ হাজিরা দিয়ে। মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ শাহবাগে গিয়েছিলেন ইস্তিখারার নামাজ আদায় করে। বাজারি শাহবাগ পাঠ বা পর্যালোচনায় মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ একক বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি হিসাবে চিত্রায়িত করে৷ ব্যক্তি ফরিদ উদ্দিন মাসুদের চেয়েও, তার চিন্তার কুলুজি ( Genealogy) , উক্ত চিন্তার বাসনা ( Desire) , প্রস্তাব (Manifesto) উক্ত নিবন্ধের অধিক আগ্রহের জায়গা। 

শাহবাগের বাজারি পাঠ - পর্যালোচনায় মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ শাহবাগে যাওয়াকে শুধুই আওয়ামী লীগ এবং নাস্তিক্যবাদের আশ্রয়স্থল হিসাবে শনাক্ত করে৷ কিন্তু মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ রশিদ জামিলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আমাদের জানাচ্ছেন, গুটিয়ক মানুষ নাস্তিক্যবাদ নিয়ে সে প্রতিবাদ করেছিল। জামাত - শিবির তার উক্ত প্রতিবাদী বক্তব্য সকলের সামনে আসতে দেয়নি৷ উল্টো কমল-মতি, সহজ - সরল আলেম দের মাঝে তাকে নিয়ে প্রোপাগাণ্ডা করেছে৷ তাসনিম আলম যেরুপ আমাদের অবহিত করছিলেন যে শাহবাগে গুটিকয় লোকের নাস্তিক্যবাদী নোংরা চিন্তার বিষয়, তদ্রুপ মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ একই দিক নিশ্চিত করছেন৷

"আমি যখন শাহবাগে গিয়েছিলাম, তখন সেই ব্যাপারটিকে জামায়াত-শিবিরের লোকজন ব্যাপকভাবে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে আমার কওমি আলেম-ওলামার সরল আবেগটাকে আমার বিরুদ্ধে টেনে নিতে চেষ্টা করেছে এবং অনেকাংশে সফলও হয়েছে। কিন্তু নাস্তিকতার বিরুদ্ধে আমার বক্তব্য বা অবস্থানের ব্যাপার কেউ সেভাবে সামনে নিয়ে আসেনি।"  

মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদকে যারা সমালোচনা করে, বিশেষত দেওবন্দী ধারা হতে ; তাদের সমালোচনা মুলত মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসুদের আত্মবিরোধ হাজির করা। আত্মবিরোধ ( self Contradiction) হাজির করে সমালোচকরা বলেন, উনি কিভাবে নাস্তিকদের সাথে আন্দোলনে গেলেন! এই সমালোচনার মাঝে যে লাইন লুকিয়ে আছে, তা হলো ; শাহবাগে যদি নাস্তিকতা - কথিত বেহায়াপনা ইত্যাদি ইত্যাদি বর্গ হাজির না হইত তাহলে শাহবাগে যাওয়া নেক কাজ হইত৷ মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ চিন্তার সংশোধনবাদী ধারা হিসাবে এই সমালোচক দের বর্গীয়করণ করা যায়৷ ফরিদ উদ্দিন মাসউদ শাহবাগ গমন অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখে বাংলাদেশের দেওবন্দী সংশোধনবাদী ধারা৷ অথচ, মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ বাসনার হদিস করলে দেখা যায়, শাহবাগে যাওয়া ই ছিল তার নিয়তি। মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদের শাহবাগ গমন কে আমরা রোগের উপসর্গ( symptom)  হিসাবে চিহ্নিত করতে পারি। রোগের সন্ধান করলে পাওয়া যায় মাওদুদিবাদ বিরোধীতার দীনি গাইরত / ইমানি দায়িত্ব। এখন প্রশ্ন হতে পারে, মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদের এই সকল কার্যকলাপ অনেক উমামায়ে কেরাম বিরোধিতা করেছিলেন। এক্ষেত্রে উত্তর হচ্ছে, জামাত মাওদুদিবাদের প্রতি যারা ঘৃণা করাকে দীনি গাইরত বা ইমানি দায়িত্ব ভাবে সেই বিশেষ ধারার সাথে শাহবাগের মিতালি হবার সম্ভবনা প্রকট৷ এ কথা সত্য যে, ২০১৩ সালে তখন সেই মিতালি গড়ে উঠে নাই। এজন্য ই ফরিদউদ্দিন মাসউদ যে চিন্তার উসুলে শাহবাগ গেলেন তাকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবছি৷ মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ শুধু প্রকাশিত সুরুত বা (Reviling Signifier). মাওদুদিবাদের বিরোধিতা বা জামাত প্রশ্নকে এড়িয়ে যদি ইসলামের রাজনৈতিকতার, ক্ষমতায়নের আলাপ তোলা হয় তাহলে দেখব কিভাবে মিশরীয় মার্ক্সবাদীদের সাথে সালাফি আলেমদের নূর পার্টির রাজনৈতিক ও বাসনাগত ঐক্যের ফলে শাহবাগের পরের সময়ে মিশরে রাবা স্কয়ারে লাশ রাজনীতি শুরু হয়৷ আগ্রহ উদ্দীপক বিষয় এই যে, মিশরীয় মার্ক্সবাদীদের সাথে সালাফি আলেমদের রাজনৈতিক ও বাসনাগত ঐক্য সফল হবার কারন ; সেখানে নাস্তিক্যবাদ, বেহায়াপনা ইত্যাদি বর্গ হাজির ছিল না। ইসলামপন্থা নির্মূলের রাজনীতি যা বাংলাদেশ ও মিশরে ঘটছিল। মিশরে ত মাওদুদিবাদ নাই। জামাতে ইসলামী নাই৷ সেখানে ইখওয়ানুল মুসলিমীনের বিরুদ্ধে মার্ক্সবাদী ও আলেমরা কেন ঐক্য করে রাবা স্কয়ারের লাশ রাজনীতি, গনহত্যা করল? এবং কি সিসির মতোন শাসককে বৈধতা দিল? ইসলামপন্থা নিমূর্লের জন্য মিশরীয় সেক্যুলার ও আলেমদের যেভাবে এক প্লাটফর্মে দেখা গিয়েছিল, তদ্রুপ মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ ও দেশীয় সেক্যুলার সমাজকে শাহবাগের মঞ্চে দেখা গিয়েছিল৷ এখানে কথিত যুদ্ধাপরাধ ইস্যু শুধুই প্রলেপ। মর্ম হচ্ছে ইসলামের রাজনৈতিকতা নির্মূল৷

৩. মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদকে নিয়ে বাজারি পাঠ-পর্যালোচনায় শাহবাগের আন্দোলনের শরিক হিসাবেই দেখা হয়। মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ যে শাহবাগের তত্ত্বয়ান করে, তার তাত্ত্বিক দিকের উন্মেষ উক্ত পাঠ-পর্যালোচনায় অনুপস্থিত। মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ ৭১ এর যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবি করে ইসলামের উসুলে। ইসলামের সাপেক্ষে যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবির তত্ত্বয়ান শাহবাগের অন্য সেক্যুলার বুদ্ধিজীবীরা কেউ করে নাই। এই দিক থেকে ফরিদ উদ্দিন মাসউদ শাহবাগের তাত্ত্বিক হিসাবে দৃশ্যপটে হাজির হয়। শাহবাগ উত্তর বাংলাদেশে অনেক আলেম, সাধারণ ইসলাম পালন করে এমন অনেক ধারা-উপধারাও মনে করে জামাত নেতা গোলাম আযম, নিজামি, সাইদি, কাদের মোল্লা, মীর কাশেম আলী, কামরুজ্জামান সহ বিএনপি নেতা সাকা চৌধুরীর বিচার ইসলামের সাপেক্ষে যৌক্তিক। আবার এদের কেউ কেউ, শাহবাগের বিচারহীনতা নিয়ে শাহবাগের পর যথেষ্ট সচেতন ; তাই তারা রোজ হাশরে বিচারের কথা জানায়৷ তাহলে দেখা যাচ্ছে ফরিদ উদ্দিন মাসউদ শাহবাগের যে তত্ত্বীয় ছক প্রস্তাব করছে তা বাজারে ভোক্তাদের টানতে সফল৷  

একাত্তরের যুদ্ধে ফরিদ উদ্দিন মাসউদ সহ উলামায়ে কেরামদের বয়ান পাওয়া যায় জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াই হিসাবে। ৭১ কে জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াই কে ইসলামের বুনিয়াদি মানদন্ডের সাপেক্ষে শাহবাগ আন্দোলনের তত্ত্বয়ান করেন ফরিদ উদ্দিন মাসউদ ৷ ৭১ এর যুদ্ধে কে জালেম? আর কে মজলুম? এই প্রশ্নের উত্তর যেন ফরিদ উদ্দিন মাসউদের কাছে আগ হতে প্রস্তুত ; যেমন সেক্যুলার সম্প্রদায়ের কাছেও প্রস্তুত থাকে। আগাম প্রস্তুতির শানে নুযূল কাশহাফ কিনা, তার সন্ধান না পাওয়া গেলেও ধরে নিতে আপত্তি কিসে! যেহেতু মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ ইস্তিখারা করেই শাহবাগের দিকে তার কদম মোবারক বাড়িয়েছিলেন৷ ফরিদ উদ্দিন মাসউদ ৭১ এর বিরোধিতাকারী, ও কথিত যুদ্ধাপরাধের বিচার চায় ইসলাম ও সামাজিক ন্যায়বিচারের পাটাতনে। কিন্তু একাত্তরের বিহারি মুসলিম গনহত্যা, পাহাড়ি গনহত্যা, প্রো পাকিস্তান সিভিলিয়ান, ইভেন নিরীহ-নিরপেক্ষ আলেমদের উপর চলা গনহত্যায় অংশ নেওয়া মুক্তিফৌজ, মুজিববাহিনী, বা ভারতীয় বাহিনী বা পাকিস্তান বাহিনীর বিচার চাইতে পারলেন না। শাহবাগে মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ যদি জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের বিচার দাবি করে, তাহলে বিহারি মুসলিম গনহত্যায় অংশীদার যারা তারা কি জালেম নয়? নাকি বিহারি মুসলিমরা জালেম। বিহারি নারীর সম্ভ্রম, বিহারিদের সম্পদ সব গনিমতের মাল হিসাবে কল্পনা করলেন, মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ? ইসলামের ফিকাহের সাপেক্ষে যদিও এই উতর তিনি দেইনি৷ তবুও জিজ্ঞেস করতে আপত্তি কই? মুসলিম নারীর সম্ভ্রম মুসলিম পুরুষ নিচ্ছে, কতল করছে, সম্পদ লুন্ঠন করছে এই দৃশ্য অবশ্যই কস্টের। কিন্তু যখন উসুল হবে ইসলাম তখন কি করে ফরিদ উদ্দিন মাসউদ এই যুদ্ধাপরাধ এড়িয়ে গেলেন? শাহবাগের সাথে সম্পর্কের অবনতি হত, তাই? তাহলে দেখা যাচ্ছে, যুদ্ধাপরাধের আলাপে ইসলামের ফিকাহের সাপেক্ষে ফরিদ উদ্দিন মাসুউদের কাছে কোন উত্তর নাই। কিন্তু সে এই ইসলামের উসুল ব্যবহার করেই শাহবাগকে বৈধতা দিয়েছে ত বটেই, নতুন করে তত্ত্বীয় ভিত দিয়েছে৷ আগ্রহের বিষয় এই যে এই তত্ত্বীয় ভিত্তি নিয়ে কোন আলেম প্রশ্ন তুলেননি। মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসুউদের সব সমালোচনা উনি কেন নাস্তিক-বেহায়াদের সাথে গেলেন। ভাবখানা এমন নাস্তিক-বেহায়াদের সাথে গেলেই শুধু ইসলাম চলে, বিহারি নারীর সম্ভ্রম, গনহত্যায় ইসলামের আদল - ইনসাফ বহাল তবিয়তে ই থাকে। মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসুউদের বিহারি গনত্যার যুদ্ধাপরাধের বিচার না চাইবার কারন সুলুকসন্ধান করলে দেখা যায় যে, তার তত্ত্বীয় ছকে ৭১ জেহাদ হিসাবে হাজির হয়। মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ, শাহবাগে ভারতীয় আধিপত্যবাদী - সম্প্রসারণবাদী নীতিকে সাদরে গ্রহন করে। ইন্দ্রানী বাগচি হিন্দুস্তান টাইমসে আর্টিকেলে দেখান " ভারত শাহবাগ আন্দোলনের প্রনোদনা দিচ্ছে "। শাহবাগের সাথে যে ভারতীয় হাইকমিশনার শ্রীরাধা দত্তের মধুর রিশতা তাও এডিয়ে যান মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ ৷ মুসলিম ভাইকে খুন করতে অমুসলিমের প্রনোদনা নিয়ে তা সম্পাদন করা ফিকহি দিক হতে কেমন তার কিছু চিত্র পাওয়া যায় ইমাম ইবনে তাইমিয়ার উছিলায়৷ ধরে নিলাম জামাত নেতারা  ফাসিক, তাই বলে অমুসলিমের কাছ থেকে সাহায্য নিয়ে ফাসেক নির্মূল করা ফিকহে অনুমোদন দেয়? ভূ-রাজনৈতিক দশায় ইসলামপন্থা নির্মূলের অনুমোদন  যে ফিকাহ দিল তার সাথে ইসলামের ফিকাহের সম্পর্ক কত টুকু? পাঠক বিবেচনা করবেন।

৪. শাহবাগের প্রস্তাবনাতে শাহবাগের বাসনা প্রকাশ পায়৷ শাহবাগের প্রস্তাবকৃত দফা সমূহের মাঝে "জামায়াত-শিবিরসহ সকল ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলের রাজনীতি নিষিদ্ধ ও তাদের নাগরিকত্ব বাতিল করা।" দফাকে আলাপের সুবিধার জন্য উদাহরণ হিসাবে সামনে আনতে পারি। এতে শাহবাগের বাসনা ও এই বাসনার সাথে ফরিদ উদ্দিন মাসউদের বাসনাগত ঐক্যের সুর ধরা পড়বে। শাহবাগের প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে, জামাত সহ সকল ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করতে, অর্থাৎ ইসলামপন্থা বা ইসলামের রাজনৈতিকতা আইনি বলে নাই করে দিতে৷ ইতিহাসে ইসলামের রাজনৈতিকতাকে আইনি বলে নাই করে দেওয়ার নজির মেলে নব্য তুরস্কে। এই পলিসি কামালবাদ বা উগ্র সেক্যুলারবাদ হিসাবে পরিচিত। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বুনিয়াদ এই কামালবাদ৷ শাহবাগে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সেই Organic Criss এর Symptoms এর দেখা মেলে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের পর আইনি বলে ইসলামের রাজনৈতিকতা নিষিদ্ধ করা হয়। শাহবাগ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কামালবাদী অবয়ব বৈকি! কিন্তু আগ্রহের বিষয়, ফরিদ উদ্দিন মাসউদ যখন শাহবাগে গেলেন তারপর থেকে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির নিষিদ্ধের স্থলে শুধু জামাত নিষিদ্ধের দাবি তোলা হয়। এখানেই মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ একজন শক্তিশালী তাত্ত্বিক হিসাবে হাজির হোন। মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানির অনুসরনে মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ তার সবটুকু উজাড় করে দিয়েছেন৷

মওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদের তত্ত্বয়ানে শাহবাগ  নয়া রাজনীতি শুরু করে৷ যদিও এই রাজনীতির ঝোঁক শাহবাগের আগেও ছিল। কিন্তু লাশ রাজনীতির বাসনায় মত্ত শাহবাগ একে মেনিফেস্টোতে আনতে ব্যর্থ হয়েছিল। মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদের নসিহার পরে, শাহবাগ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের দাবিকে লঘু করে শুধু জামাত নিষিদ্ধ দাবি তুলে। শাহবাগের আরেক বুদ্ধিজীবি বিনায়ক সেন প্রস্তাব করে, আলেম- ওমাদের অংশগ্রহন ও শাহবাগে জুরুরি। এইযে অংশগ্রহণমূলক শাহবাগের কারিগর মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ তা তার সমালোচকরা চিহ্নিত না করে, হাসি তামাশা করে৷ অর্থাৎ শাহবাগ শুধু খারিজি লাশ রাজনীতি করছে না, সাথে অংশগ্রহণমুলক ( Inclusive) রাজনীতিও করছে। আর এই অংশগ্রহনমুলক রাজনীতির বৈধতা ও তত্ত্বায়ন করেছেন মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ৷ মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানি এই চিন্তার প্রধান রাজনৈতিক তাত্ত্বিক যা তিনি সফল ভাবে ৪৭ এ কংগ্রেসকে সাথে নিয়ে করেছেন। পক্ষান্তরে, মুসলিম লীগ ও তাদের সমর্থনকারী আলেম-ওলামাদের "সাম্প্রদায়িক " "জাতিবাদি " " পরিচয়বাদী " ইত্যাদি ইত্যাদি ট্যাগিং করা হয়েছে। ইতিহাসের সেই পুনঃ উৎপাদন ঘটেছে শাহবাগের সময়। ফরিদ উদ্দিন মাসউদ যেখানে মাওলানা মাদানির মতোন সামাজিক ন্যায়বিচারবাদী বা অসাম্প্রদায়িক, সেখানে যেসব আলেম ওলেমা শাহবাগে যায়নি, বিরোধিতা করেছে , তাদেরকে সেক্যুলার সম্প্রদায় "সাম্প্রদায়িক "  "জাতিবাদি " "মৌলবাদী " বর্গে ফেলা হলো। শাহবাগ শুধু খারিজি রাজনীতি করে না, সাথে অন্তর্ভুক্তির রাজনীতিও করে৷ শাহবাগের অন্তর্ভুক্তির রাজনীতিতে অংশ না নিলে নাগরিকত্ত্ব থাকে না৷ ন্যাক্রো পলিটিক্যাল অবজেক্ট হতে হয়৷

শাহবাগ জামাতের ইসলামীর রাজনীতি নির্মূলে ফরিদ উদ্দিন মাসউদের মতোন ইনক্লুসিভ আলেম পেল। ফরিদ উদ্দিন মাসউদের শুধু জামাতের রাজনীতি নিষিদ্ধ, নির্মূল করেই বাসনার পরিপূর্ণতা পায় না৷ সে শাহবাগের প্রস্তাবনার আরেক দফা, জামাতের আর্থিক প্রতিষ্ঠান যেমন ব্যাংক, শিল্প প্রতিষ্ঠান বাজেয়াপ্ত করতে বলেন। এমনকি শাহবাগের পরেও, সে এই সংগ্রাম জারি রাখেন৷ সরকারের ওয়ার অন টেরর প্রকল্প 'জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে ইসলামের ভূমিকা ও বাংলাদেশ’ পরিপ্রেক্ষিত শীর্ষক আলোচনা সভায় ফরিদ উদ্দিন মাসউদ জামাতে ইসলামীকে টেরোরিস্ট সংগঠন আইএসের চেয়ে অধিক ভয়াবহ বলে উল্লেখ করেন৷ 

'যে দেশে জামায়াতে ইসলামীর মতো দল আছে, সেই দেশে আইএস থাকার থাকার দরকার নেই। এরা আইএসের চেয়েও ভয়াবহ। একাত্তর সালে জামায়াত যে ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চালিয়েছে, তা আইএসের বর্বরতাকে হার মানায়।’

জামাতে ইসলামীর মতোন আইনের মধ্যে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংগঠনকে আইএস বানিয়ে দেওয়ার মতোন নির্বিচারবাদীতা করলেন ফরিদ উদ্দিন মাসউদ৷ এই নির্বিচারবাদীতাতে যদি ইতি ঘটত, তাও সাত খুন মাপ করা যেত। কিন্তু তিনি পুনঃরায় রাষ্ট্র ও সরকারকে জামাতে ইসলামীকে দমন করার আহবান জানান৷ এই দমননীতি শুরু করার সহি পথ বাতলে দেন।

"জামায়াত উগ্রবাদ লালন-পালন করে। এদের বাংলাদেশে রেখে দেশ থেকে জঙ্গিবাদ দূর করা সম্ভব নয়। তাদের নির্মূল করতে হলে সবার আগে তাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করতে হবে। জামায়াতকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেই জঙ্গিবাদকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।’

জামাতের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ করাকে ফরিদ উদ্দিন মাসউদ নেক কাজ মনে করেন৷ কারন জামাতে ইসলামী ইসলামের ক্ষতি করছে। ফরিদ উদ্দিন মাসউদ সেই ক্ষতি হতে ইসলামকে রক্ষা করতে উপরিক্ত পথ বাতলে দিচ্ছেন। দাওয়াত দিচ্ছেন৷ জামাতের সাথে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই৷

"এরা ইসলামের অনেক ক্ষতি করেছে। আবু জেহেলরাও এত ক্ষতি করেনি। এদের সঙ্গে ইসলামের সম্পর্ক নেই।"

শাহবাগ আন্দোলনকালীন জামাতে ইসলামী নির্মূলের জন্য মাওলানা আহমদ শফিকে তিনি চিঠি লিখেন৷ উক্ত চিঠিতে প্রস্তাব করায় হয় যে, শাপলার ১৩ দফার সাথে জামাতে ইসলাম নিষিদ্ধের একটি দফা যুক্ত করতে।

"আমি অনুরোধ জানিয়েছিলাম দাবিগুলোর সাথে আরেকটি দাবি যুক্ত করে নিতে। সেটি হলো জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা।"

৫. 'The desire for an enemy, the desire for apartheid for separation and enclaving, the fantasy of extermination- all today occupy the space of this enchanted circle’

- Achille Mbembe, Necropolitics

আশিলি এম্বেম্বে দেখান লাশতান্ত্রিক ক্ষমতা (Necro-Power) কিভাবে এমন এক দুশমণের ( Enemy) কল্পনা করে, যার নির্মূলের মাধ্যমেই বিনাশ সম্ভব৷ তাই লাশতান্ত্রিক ক্ষমতা শরীলের সন্ধান করে তার ক্ষমতা কায়েম করতে৷ শাহবাগের এই লাশতন্ত্র ( Necropolitics) নিয়ে রাজনীতি তাত্ত্বিক তরিকুল হুদা তার "সাম্য-মানবিক মর্যাদা তথা স্বাধীনতা ও গনতন্ত্রের হম্বিতম্বি, গালগপ্পোঃ শাহাবাগী লাশতন্ত্রের খতিয়ান" প্রবন্ধে দেখান কিভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বুনিয়াদ শাহবাগ আন্দোলনে ইসলামপন্থা নির্মূলের জন্য লাশ রাজনীতি করার উপায় বাতলে দেয়৷ হুদা স্মরণ করিয়ে দেয়, এই লাশ সাম্য-মানবিক মর্যাদা তথা স্বাধীনতা ও গনতন্ত্রের হম্বিতম্বি, গালগপ্পোঃ শাহাবাগী লাশতন্ত্রের খতিয়ান" প্রবন্ধে দেখান কিভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বুনিয়াদ শাহবাগ আন্দোলনে ইসলামপন্থা নির্মূলের জন্য লাশ রাজনীতি করার উপায় বাতলে দেয়৷ এই লাশতান্ত্রিক ক্ষমতার (Necro- Power) চর্চার দেখা মেলে মিশরের রাবা স্কয়ারে। মিশরেও ইসলামপন্থা নির্মূলে এই লাশতান্ত্রিক রাজনীতি করা হয়। শাহবাগে সেক্যুলারদের ন্যায় মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসুদ এই লাশতান্ত্রিক রাজনীতি করেন৷ জামাতে ইসলামী নির্মূল, গনতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলকে আইএসের অভিধা দিয়ে ওয়ার অন টেরের রাজনীতি, রাষ্ট্র ও আইনি বলে রাজনৈতিকতা নিষিদ্ধ করার দাবি, আর্থিক প্রতিষ্ঠান দখল করবার নসিহত ইত্যাদি ইত্যাদির মাধ্যমে তার নির্মূলের বাসনা স্পষ্ট ভাবে প্রকাশ পায়৷ এই বাসনার আদি উৎস মাওদুদিবাদের বিরোধিতা। ফরিদ উদ্দিন মাসউদের মতে এই বাসনা নেক৷ সাহাবের সম্মানের হেফাজত করতে , আকাবিরে দেওবন্দের বাতলে দেওয়া পথেই ফরিদ উদ্দিন মাসউদ এই লাশতান্ত্রিক রাজনীতির অংশীদারিত্ব করে৷ মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদের জবানিতে :

"আমি আজীবন মওদুদিবাদের বিরোধিতা করে আসছি। এই মিশন নিয়ে আমি কাজ করছি সারাজীবন। এই কাজটি আমি পেয়েছি আমার আকাবির-আসলাফ তথা ওলামায়ে দেওবন্দের কাছ থেকে। আপনি জানেন, মওদুদিয়্যতের সাথে আমাদের মূল বিরোধটা হলো আকাইদ সংক্রান্ত। ইসমতে আম্বিয়া এবং আদালতে সাহাবা সংক্রান্ত। মওদুদিরা আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামকে ‘মাসুম আনিল খাতা’ মানে না। সাহাবায়ে কেরামকে সমালোচনার ঊর্ধ্বে স্বীকার করে না। আর ইসমতে আম্বিয়া এবং আদালতে সাহাবা অস্বীকারকারীদের বিরোধিতা করাকে আমি একটি নেক কাজ এবং শ্রেষ্ঠ ইবাদত মনে করি। শাহবাগের জমায়েতকে আমার কাছে একটি সুবর্ণ সুযোগ মনে হয়েছিল। আমার কাছে মনে হয়েছিল সাহাবার দুশমনদের বিরুদ্ধে এটি একটি শক্ত অবস্থান। এই সুযোগকে কাজে লাগানো যেতে পারে। এই নেক নিয়তেই আমি সেখানে গিয়েছিলাম। "

আকাবিরে দেওবন্দের সাথে মাওদুদির ধর্মতত্ত্বীয় বিরোধ ছিল বা আছে, এক কথা সত্য হলেও আকাবিরে দেওবন্দ কি খুন করবার অনুমোদন দেয়? মাওদুদি বা মাওদুদির অনুসারীরা কি মুরতাদ হয়ে গেছে? ফরিদ উদ্দিন মাসউদ এখানে আকাবিরে দেওবন্দ বলে সত্য লুকাতে চাচ্ছে৷ মাওলানা আশরাফ আলী থানভি রহ: সহ তার ধারার গুরুত্বপূর্ণ আলেম যেমন মাওলানা শাব্বির আহমদ উসমানি, জাফর আহমদ উসমানি মাওদুদির চিন্তার পর্যালোচনা হাজির করছে, আবার একই সাথে পাকিস্তানে ইসলামিক শাসনতান্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন৷ পাকিস্তানে আধুনিক মুসলিম, আধুনিক ইসলামপন্থীদের সাথে ঐতিহ্যবাদী দেওবন্দীরা এক সাথে কাজ করেছে। অতএব, ফরিদ উদ্দিন মাসউদ যে নির্বিচারবাদিতায় লিপ্ত হয়ে তা আড়াল করতে কপটতার আশ্রয় নিচ্ছে। এখানে ফরিদ উদ্দিন মাসউদ তার মাদানি বাসনা লুকাতে চাচ্ছে। এই মাদানি বাসনার গোড়া পাকিস্তান রাষ্ট্রকে না মেনে নেওয়ার ভিতর। মাদানি ধারার আলেমদের ঘৃনার চাষ এতো ই যে, তারা সেক্যুলার দের সৈনিক হবার মাধ্যমে ইনক্লুসিভ চরিত্রে লাশ রাজনীতি করতেও শরমিন্দা নয়৷ ফাসিকের লাশ ফেলবার মাধ্যমে যেন ইসলাম রক্ষা নিহিত। ফরিদ উদ্দিন মাসউদের মতোন দীনি গাইরতে, ইমানি দায়িত্বে, নেক নিয়তে কথিত এন্টি মাওদুদিবাদ যেন শাহবাগের দরজা।

 

দোহাই

১.https://www.risingbd.com/amp/national/news/138676

২.https://mahabub.home.blog/2019/10/23/%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%93%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%BE-%E0%A6%AB%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%A6-%E0%A6%89%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A6%BF%E0%A6%A8-%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A6%89/

৩.https://www.milestonesjournal.net/shapla-10-year-anniversary-1/2024/1/15/-