রাষ্ট্রে সার্বভৌমত্বঃ তুমি কার, কে তোমার?
By Tareq-ul Huda
Preface
উপনিবেশ শেষ হলেও, উপনিবেশিকতা বহাল তবিয়তে রয়ে গেছে৷ আধুনিক রাষ্ট্রে সেই উপনিবেশিকতার দাগ বর্তমান। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বুনিয়াদি কাঠামোতে ফরাসি - ইংরেজ - ভারতীয় মডেলের উপনিবেশি জাতিরাষ্ট্র বা মার্কিন রিপাবলিকান মডেলের প্রভাব একচ্ছত্র এবং সূদুরপ্রসারী। ফরাসি-মার্কিন-ভারতীয় স্পিরিটকে ইউনিভার্সল কল্পনা করে, সাম্য - মানবিক মর্যাদা ভিত্তিক যে রাজনৈতিকতা ও সার্বভৌমত্ত্বের প্রস্তাব করা হয় ; সেই আধিপত্যবাদী জ্ঞানতত্ত্বীয় বাক্সের বাইরে চিন্তা ও তৎপরতার চিহ্ন হিসাবে উক্ত প্রবন্ধকে শনাক্ত করা যায়। রাষ্ট্র সংক্রান্ত চিন্তায় ইউরোপীয় আধুনিক সেক্যুলার জাতিরাষ্ট্র বা রিপাবলিক যে আমাদের একমাত্র মঞ্জিলে মকসুদ না, এর বাইরেও উঁকি দেওয়ার সুযোগ-সম্ভবনা জারি আছে তা এই প্রবন্ধের শক্তিমত্তা হিসাবে শনাক্ত করতে পারি। প্রাবন্ধিক মুন্সিয়ানার সাথে তুলে ধরেছেন যে তালাল আসাদ তার পিতা মুহাম্মদ আসাদের রাষ্ট্রচিন্তার যে পর্যালোচনা হাজির করে, তা দিনশেষে জিনিওলজিস্ট হিসাবে নয় ; বরং তা মতাদর্শিক পাটাতনে দাঁড়িয়ে। আধুনিক রাষ্ট্র ও ক্ষমতাকে এড়িয়ে যে সামাজিক আন্দোলনকে অগ্রাধিকার দিয়ে ইসলামি রাজনীতির প্রতি যে প্রস্তাব তালাল আসাদ করেন, প্রাবন্ধিক তার উৎসের সুলুকসন্ধান করে পর্যালোচনা হাজির করে৷ উক্ত প্রবন্ধ আজকের রাজনৈতিক বর্তমানে দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ প্রস্তাব করে, যেখানে মুসলিম রাজনৈতিক কর্তাসত্ত্বা ও আধুনিক নাগরিক সত্ত্বা পরস্পরের প্রতিপক্ষ নয়, বরং পরিপূরক। উক্ত প্রবন্ধ ফাহমিদ-উর-রহমান সংকলিত ও সম্পাদিত " মুহাম্মদ আসাদ : বাংলাদেশের অভিবাদন " বইয়ে আসাদ তনয় তালাল আসাদের "Mohammad Asad between Religion and Politics " আর্টিকেলের পর্যালোচনা হিসাবে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল৷ আধুনিক রাষ্ট্র, ইসলাম, ইসলামের রাজনৈতিকতা তথা ইসলামপন্থা, সার্বভৌমত্ত্ব, ক্ষমতার নানা মাত্রা, অরাজনৈতিক সামাজিক - দাওয়াতি আন্দোলন নিয়ে জনপরিসরে যে বাহাস চলমান, তার উছিলায় প্রবন্ধের পুনঃরায় প্রকাশ চিন্তা ও তৎপরতার সাপেক্ষে ইতিবাচক বটে! উম্মিদ রাখি, মাইলস্টোন জার্নাল এই ইতিবাচক দিক বহাল রাখবে।
Abdur Rahman Bari
February 21, 2024
قُلِ اللَّهُمَّ مَالِكَ الْمُلْكِ تُؤْتِي الْمُلْكَ مَن تَشَاء وَتَنزِعُ الْمُلْكَ مِمَّن تَشَاء وَتُعِزُّ مَن تَشَاء وَتُذِلُّ مَن تَشَاء بِيَدِكَ الْخَيْرُ إِنَّكَ عَلَىَ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
বলুন ইয়া আল্লাহ! তুমিই সার্বভৌম শক্তির অধিকারী। তুমি যাকে ইচ্ছা রাজ্য দান কর এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা রাজ্য ছিনিয়ে নাও এবং যাকে ইচ্ছা সম্মান দান কর আর যাকে ইচ্ছা অপমানে পতিত কর। তোমারই হাতে রয়েছে যাবতীয় কল্যাণ। নিশ্চয়ই তুমি সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাশীল। [ সুরা ইমরান ৩:২৬ ]
রাস্ট্র সংক্রান্ত সাধারন পর্যালোচনার বিষয় যদি ইসলামী রাস্ট্র হয়, তবে বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে (যেমন ইসলাম পন্থার সমালোচনা) তা রাস্ট্রের সুরত বা বহিরাবয়বের আলাপ ছাড়া আরো গভীর মর্মে যেতে পারে না। এর পিছনে মূল কারন, এই ধরনের আলাপের ভিতরে আগাম অনুমান, ধারনা হিসাবে " আধুনিক রাস্ট্র" হাজির থাকে। যার অর্থ মোটামুটি স্থির, নিশ্চল, অনড়। এতে আধুনিক রাস্ট্র নামক ঐতিহাসিক কাঠামোর পাটাতনে ইসলামী রাস্ট্রকে রেখে, ধর তক্তা মার পেড়েক গোছের একটা ব্যাখ্যা হাজির করা হয়ে থাকে। ইসলামী রাস্ট্রে ইসলামী কিছু নাই, বা এর ভিত্তি নিছক মুসলিম জাতীবাদ, ইসলামী রাস্ট্র আর যে কোন সেক্যুলার রিপাবলিক এক - এই ধরনের একাট্টা স্টেরিওটাইপিং হলো এই রকমের খন্ডিত দৃস্টির উদাহরন। বিদ্যমান যুক্তির বেড়াজাল কাটিয়ে গভীরে বুঝার জন্যে যেই শক্তি ও পরিশ্রম দরকার, যেই অনুসন্ধানী, বিশ্লেষনী এবং বিচার মূলক দৃস্টি দরকার, তা না থাকলে নিছক মার্কিন এবং ফরাসী সংবিধানের নকল এই সিদ্ধান্তগুলি অতি সাধারনীকরন এবং অতি রিডাকশন বা সংকুচিতকরন বা রাজনৈতিক প্রেজুডিস বা সংস্কার ছাড়া আর কিছু না। এই পদ্ধতির অন্যতম বৈশিস্ট্য হলো ইতিহাসকে বিচ্ছিন্ন ভাবে পাঠ এবং সমকালীন রাজনৈতিক নানা ধারাকে বুঝতে ব্যর্থতা। উদাহরন হিসাবে আরো বলা যেতে পারে, খিলাফা উত্তর শাসন ব্যবস্থার অনুকূলে, ভূখন্ড অথবা সরকার ও রাস্ট্র ব্যবস্থা, ধর্মীয় ব্যবস্থা বা মতাদর্শিক দিক, সামাজিক সাংস্কৃতিক এমনকি অর্থনৈতিক এবং আইন ও বিচার ব্যবস্থার দিক থেকে এক বিপূল পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিতে বিপুল পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে যেতে হয়েছে। এই পরিবর্তন এবং তার সাপেক্ষে মুসলিম জনগনের প্রতিরোধ বা অভিযোজন প্রক্রিয়াতেও অঞ্চলভেদে অনেক বৈচিত্র্য পার্থক্য আছে, আবার অমিলও আছে। বিষয়গুলি নিতান্তই আধুনিক রাস্ট্র সম্পর্কীত গানিতিক সমীকরন না। এর ভিতর যে অনেক ঘোলা ধূসরতা আছে। এই সমস্যাজনক বয়ানগুলির দুই লাইনের মাঝখানে যেই ফাঁকা স্থান আছে এবং সেখানে সত্য গোপন রাখা আছে, মূল অর্থ লুকিয়ে ফেলা হয়েছে। বিদ্যমান আধিপত্যকামী বয়ানের শব্দগুলির ভিতরে যেই কথা বলা হয় নাই বা চেপে রাখা হয়েছে, তাকে আমরা অবমুক্ত করার ইরাদা থেকেই এই লিখার সূত্রপাত।
ইসলাম পন্থার বিশ্লেষন করতে গিয়ে উত্তর উপনিবেশবাদ বিশেষজ্ঞ মাহমুদ মামদানি বলেন, “contemporary, modern, political Islam developed as a response to colonialism. Colonialism posed a double challenge, external and internal, the challenge of foreign domination and of the need of internal reform to address weaknesses exposed by external aggression”। আমরা লক্ষ্য করলে দেখবো যে, হিন্দুস্তানে উপনিবেশ কালের শেষে যেই দুইটি স্বাধীন আধুনিক রাস্ট্রের উদয় ঘটেছিলো, তাও কিন্তু মামদানী তত্ত্বায়নের বাইরে নয়। নতুন রাস্ট্র যেন স্পস্টত ইসলাম বিরোধী না হয়, এই জন্যে এক অনন্য সৃস্টিশীলতার নজির রাখতে পেরেছিলেন সেই সময়ের মুসলিম সমাজের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ত্ব ও চিন্তাবিদেরা। এর অনবদ্য ঐতিহাসিক নজির হয়ে আছে পাকিস্তান রাস্ট্রের সংভিধানের অব্জেক্টিভ রেস্যুলউশন তৈরির প্রক্রিয়া, যার ভিতরে মুসলিম রাজনৈতিক সমাজের প্রতিটা ধারার সক্রিয় অংশগ্রহন লক্ষণীয়। দেওবন্দী ধারার আকাবীর মাওলানা সাব্বির আহমেদ উসমানির সরাসরি প্রভাবে আমাদের সিলেট থেকে নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী নওয়াবজাদা লিয়াকত আলী খান এই প্রস্তাব উত্থাপন করেন এবং পরে তা সংবিধানে সংযোজিত হয়। সেখানে পরিস্কার ভাবে প্রথমেই বলা হয়েছে, “ Sovereignty over the entire world belongs to Allah Almighty alone and the authority which He has delegated to the state of Pakistan, through its people for being exercised within the limits prescribed by Him is a sacred trust.”এখানে পরিস্কার ভাবে মহান আল্লাহর আল হাকাম গুনের মর্যাদার সাক্ষ্য দেওয়া হয়েছে। রাস্ট্র এই গুনের স্বীকারোক্তি দেয়, তাতে আস্থা জানায় এবং আল্লাহর এই ক্ষমতার ভিতর দিয়েই রাস্ট্রত্বের অধিকার প্রাপ্ত হয় বলে কৃতজ্ঞতার সাথে ঘোষনা দেয়ার মাধ্যমে কুরআনের সুরা আল ইমরানের ২৬ নং আয়াতে বর্নিত আদেশ বা ইম্প্যারেটিভ বাস্তবায়ন করে। কোন অবস্থাতে নিজেকে নিজে সার্বভৌম দাবী করে না। সংবিধানের প্রধান এই মূলনীতির প্রয়োগের মাধ্যমে আধুনিক রাস্ট্রের আরেক প্রকরণ ইসলামী রাস্ট্র কায়েম করা হয়। আমরা দেখতে পাই পাকিস্তান সংবিধান সভা খুবই দীর্ঘ সময় নিয়ে অত্যন্ত পরিশ্রম সাধ্য যেই প্রক্রিয়ায় সংবিধান প্রনয়ন করে। এক পর্যায়ে মুহম্মদ আসাদও মুসলিম জাতীয়তাবাদী, দেওবন্দী, শিয়া, আধুনিক সেক্যুলার মুসলিম, এমনকি অমুসলিমদের এই দীর্ঘ কাফেলায় সামিল হন। এর আগে যেই মক্কাগামী কাফেলায় শরিক হয়েছিলেন উইরোপীয় আসাদ, সেই একই কাফেলার পরবর্তী যাত্রার দিকে তিনি এভাবেই ধাবিত হন। পাকিস্তানের রাস্ট্রের প্রথম নাগরিক পাসপোর্ট তাকেই দেওয়া হয়েছিলো।
মুহম্মদ আসাদের রাস্ট্র বাসনাঃ
আসাদের কাছে পাকিস্তান রাস্ট্রের বাসনা এই অঞ্চলের মুসলিমদের রাজনৈতিক বাসনারই স্বাভাবিক স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। আসাদ খুব গুরুত্ত্ব দিয়ে উপনিবেশী কাঠামো থেকে নতুন রাস্ট্রকে অবমুক্ত করতে চেয়েছিলেন। একাধারে ইউরোপ, মধ্য এশিয়া এবং দক্ষিন পূর্ব এশিয়ার অভিজ্ঞতা ঋদ্ধ আসাদ অনেক আগেই বুঝেছিলেন যে, উপনিবেশী দখল ছাড়ার পরেও বৃটিশরা পশ্চিমা ছকের বাইরে যেন নতুন স্বাধীন রাস্ট্রগুলি যেতে না পারে, তা নিশ্চিত করার জন্যে প্রানান্ত চেস্টা চালাবে। তাই একদিকে জাতীয়তাবাদ, অপরদিকে সেক্যুলারিজমের খপ্পর থেকে দূরে থাকতে পারাটাকে নতুন রাস্ট্রের জন্যে অবশ্য কর্তব্য মনে করতেন তিনি। পাকিস্তানের সংবিধান সভার উদ্দেশ্যে নিজের প্রস্তাবগুলির সংকলন “ ইসলামী রাস্ট্র ও সরকারের মূলনীতি” বইয়ে উনি এক নৈতিক ইরাদার ইশারা দেন। প্রচলিত পশ্চিমা আদর্শের লিবারেল সেক্যুলার রাস্ট্র অথবা আধুনিক ইসলামী রাস্ট্রর ভিতরে দ্বিতীয়টিকে বাছাইকরনের ভিতর দিয়ে তা মূর্ত হতে শুরু করে। এখানে লক্ষ্যনীয় আসাদের ভিতর রিজন বা বুদ্ধিবৃত্তিক যৌক্তিকতা পশ্চিমা কান্টিয় ধারার প্রভাব দেখা গেলেও তা পজিটিভিজম এবং এনলাইটেন্মেন্ট প্রভাবিত নির্বিচার বুদ্ধিবাদে পরিনত হয় নাই। বরং এর ভিতরে এক ধরনের নিউ কান্টিয়ান প্রবনতা দেখা যায়, যেমনটা ফেনোমেনলজিতে বাঁক নেওয়া হুসার্লের চিন্তার ক্ষেত্রে ঘটেছিলো। বৈশিষ্ট্যটা হলো, যেন বুদ্ধির ভিতরেই বুদ্ধির সীমায় পৌছে গিয়ে তার বাইরে দেখতে চাওয়া।
জনগনের যেই নৈতিক ইচ্ছা প্রকাশের মাধ্যমে আল্লাহর গুন আল হাকাম থেকে উৎসারিত সর্বোচ্চ ক্ষমতা আল্লাহর সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করে নেয়, তা ইসলামী রাস্ট্রের বিচারিক এবং নির্বাহী প্রক্রিয়ায় মারুফ (নৈতিক অর্থে সৎ কর্ম) এবং মুনকার(অনৈতিক অর্থে অসৎ কর্ম) সংক্রান্ত ইসলামী নীতিমালা বাস্তবায়ন করে। তবে আসাদ এও মনে করেন যে, এই পুরো প্রক্রিয়া নিছক মুসলিম জাতিবাদী সাংস্কৃতিক আবেগ অথবা ধর্মীয় আচার নিষ্ঠতার ভিতর দিয়ে ধরা যাবে না। আবার শুধুমাত্র ধর্মীয় আইডেন্টিটি বা আত্ম পরিচয়ের বিষয়ও না। বরং ‘মুসলিম জাতীবাদ’, ‘ধর্মীয় আইডেন্টিটি’ ইত্যাদি রাজনৈতিক ক্যাটেগরির ভিত্তি ঐতিহাসিক পশ্চিমা নিধর্মীকৃত বা সেক্যুলার খ্রিস্টিয় দেহ-মন দ্বৈতবাদীতায় নিহিত। এনলাইটেন্মেন্ট যা কিছু খারিজ করে নিজের অপরে পরিনত করে, তা যদি আবারো তার সামনে বিষয় আকারে হাজির হয়, তখন এই আধিপত্যের বয়ানে তাকে ‘মুসলিম জাতীবাদ’, ‘ধর্মীয় আত্মপরিচয়’ ইত্যাদি শব্দ বন্ধনীতে সংকুচিত করে তাকে পশ্চিমা অর্থে প্রগতি বিরোধী সমস্যা আকারে দেখানো হয়। এই প্রক্রিয়ার পর্যালোচনা ও বিচার করে, তারই আধুনিক বিকল্প হাজির করতে পারে এমন মতাদর্শের পরিগঠন এবং বিকাশই আসাদের ইসলামী রাস্ট্রের আধুনিক মডেল। আসাদের ভাষায়, “ In a modern secular state there is no stable norm by which to judge between good and evil, and between right and wrong. The only possible criterion is the “nation’s interest”. But in the absence of an objective scale of moral values, different groups of people – even within one nation – may have and usually do have widely divergent views as to what constitutes the nation’s best interests. He has further said: “It has become evident that none of the contemporary Western political system – economic liberalism, communism, national socialism, social democracy and so forth – is able to transform that chaos into something resembling order: simply none of them has ever made a serious attempt to consider political and social problems in the light of absolute moral principles.”
আসাদের জীবনের অন্যতম দিক হলো দেশ থেকে মহাদেশ, সভ্যতা থেকে সভ্যতায় অভিযাত্রা। এর ভিতর দিয়ে লব্ধ অভিজ্ঞতায় উনি অনেক কিছুই বুঝতে পেরেছিলেন যা পুঁথিগত বইয়ের ভিতরে থাকে না। তবে একথাও বলে রাখতে হবে যে, উনার সহিহ আল বুখারীর অনুবাদের একটা মূল উদ্দেশ্য ছিলো, আরবী জানেনা এমন জনগোষ্ঠীর কাছে এই অতীব গুরুত্ত্বপূর্ন হাদিস সংকলনের প্রাপ্তি নিশ্চিত করা, যেন তাদের ভিতর ইজতেহাদী প্রবনতা তৈরি হয়। এর অন্যতম দিক হলো ঐতিহ্যপন্থী ওলামাদের উপর নির্ভরশীলতা কমানো। এখানে বলা রাখা দরকার আসাদের ভিতর এই বুদ্ধি বা আকল কেন্দ্রিকতা আধুনিক চিন্তারই বৈশিষ্ট্য। যার ফলে ইজতেহাদী প্রাধান্য খেয়াল করার মতো। এতে ফিকহী জটিলতা তৈরি হয়। তার পরেও আধুনিক জ্ঞান কান্ডে ইসলামী ধারার অনুপ্রবেশ ঘটানো যায়। যদি এই ধরনের ইজতেহাদঈ সিদ্ধান্ত আবার ফিকহী যাচাই বাছাই করন করা যায়, তবে এর সম্ভাব্য ভূল এবং অসামঞ্জস্য গুলি এড়ানো যাবার সম্ভাবনা তৈরি করা যায়।
মুহম্মদ আসাদের মূল্যায়ন ও বিচারে তালাল আসাদের চিন্তার পর্যালোচনাঃ
সমকালীন বিখ্যাত চিন্তাবিদ এবং আসাদ তনয় তালাল আসাদ পিতার চিন্তার একটি অতীব গুরুত্ত্বপূর্ন মূল্যায়ন হাজির করেন। তালাল সেখানে আসাদের যুক্তিপ্রবনতার মাধ্যমে ধর্মীয় উপলব্ধির পদ্ধতির কথা তুলে ধরেন। আসাদের ভাষায়, “The first and most important idea in my father’s vision has to do with his con-viction that access to Islam is based on reason, and that therefore argument is necessary to becoming and being a Muslim. When I was a boy he used to tell me that one must try to persuade other Muslims and non-believers not by force but by reason: This is what the Qur’an means by saying lā ikrāha fi-ddīn.” আসাদের যুক্তিপ্রবনতার বিষয়টি আগেও উল্লেখ করেছি। তবে আরেকটি নোক্তা এখানে রাখা যায়। আধুনিকতার আরেক পুরোধা হেগেল দেখিয়েছেন, মানুষের ইন্দ্রিয় প্রবনতা আত্মসচেতন হয়ে উঠার মাধ্যমে পরম ভাবে পৌছে যার মর্মে মূলত খ্রিস্টান ধর্ম। পরম ভাব এমনই যে জানে যে সে পরম। এর আগের ইন্দ্রিয়পরায়নতার প্রথম ধাপে তা সে বুঝতে পারে না। কিন্তু ধাপে ধাপে আত্মসচেতন হয়ে পরম ভাব হয়ে উঠে। আসাদ বুদ্ধি বা রিজনকে ঠিক হেগেলীয় অর্থে ব্যবহার করেন নাই। হাকিমিয়াত যৌক্তিক নয় এবং আসাদ হাকিমিয়াতকে যৌক্তিক বলেছেন এমনটা নজরে আসে নাই। বরং বান্দা বা সসীম অস্তিত্ত্ব হাকিমিয়াতকে উপলব্ধি করার পদ্ধতি যৌক্তিক। ‘আল হাকাম’ রাস্ট্র বা যে কোন সার্বিক এবং বিশেষ যৌক্তিক কাঠামো নিরপেক্ষ অনন্য সত্তা আল্লাহর গুন। বিষয়টি তালাল ঠিক খোলাসা করতে পারেন নাই। ঠিক এখান থেকেই আসাদ যে অর্থে ‘সার্বভৌমত্ব’ ব্যবহার করেছেন, সেই অর্থ গুলিয়ে ফেলা শুরু করেন তালাল। বিষয়টি বুঝতে আমরা অর্থের আরেকটু গভীরে প্রবেশ করবো।
তালাল জর্মান রাজনীতি তাত্ত্বিক, সংবিধান ও আইন বিশেষজ্ঞ কার্ল স্মিটকে টেনে বলেন, “ Unlike Carl Schmitt’s famous theory of “sovereignty” that expounds a political the-ology, in the salafi tradition the state cannot be legitimized through a secularized concept of divinity, on the analogy of what Schmitt called the sovereign’s ability to determine the exception in law and God’s ability to intervene in the order of nature by miracles. In that Islamic tradition, God cannot be conceived of as a heavenly Patriarch (as in the early modern European tradition of the divine right of kings), or as the founder of a heavenly Covenant (as in early modern political discourses on social contract). A corollary of the absence of a theory of “sover-eignty” in this tradition is that the modern state has no claim on the absolute loyalty of its subjects. Many advocates of an Islamic state today assert that God has absolute sovereignty over it. But since Qur’anic doctrine insists that everything in the universe is subject to divine sovereignty, how does the state, as a social construct, get its special right to demand absolute loyalty from its subjects? It is precisely because no state can claim divine sovereignty that no spokesperson of an Islamic state can do so. The state may be necessary in our contemporary world for a number of desired functions that only it can perform, and to the extent that it does this in ways considered just and efficient, support from its subjects – as well as from foreigners who live in or visit its territory – will be forthcoming. But the state has no theological title to sovereignty in Islam because unlike Schmitt’s argument that invokes a Christian history, the Islamic state cannot speak as God would speak. It is a creation, not the Creator.
প্রথমত, সাধারন ক্যেটেগরি আকারে ‘সালাফী ঐতিহ্য’ বললে, তার ভিতর বিভিন্ন সালাফী ধারার পার্থক্য বজায় থাকে না। মাদখালি সালাফিরা রাস্ট্রের যে কোন রুপের ক্ষেত্রে এমন ভাবেই নাগরিকদের আনুগত্য দাবী করে, যা প্রায় আকিদার পর্যায়ে গিয়ে পড়ে। ব্যাপারটি অত্যন্ত সমস্যাজনক। সালাফি ঐতিহ্য অনুযায়ী আধুনিক রাস্ট্র নাগরিকদের কাছে আনুগত্য দাবী করতে পারে না বলে তালাল যে অনুমান করেন, তা এই উদাহরনের সাপেক্ষে দাঁড়ায় না। আবার উনি যে বলেন, এই ধারায় সার্বভৌমত্বের কোন তত্ত্ব নাই সেটাও ঠিক না। মাওলানা মাওদূদী প্রভাবিত ইসলামপন্থীরা মোটা দাগে সালাফী হবার পরেও হাকিমিয়াতের ভিতর দিয়ে আধুনিক রাস্ট্র পরিচালনা করে নাগরিকদের আনুগত্য নিশ্চিত করা যায় এমন আদরশ পোষন করেন। আসাদ বুঝতে পারেন নাই যে, সৃস্ট সসীম ঐতিহাসিক ইসলামী রাস্ট্র কখনোই সার্বভৌমত্বের দাবী করে না, বা নিরঙ্কুশ ভাবে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের জায়গা থেকে নাগরিকদের কাছে আনুগত্য দাবী করে না। বরং সে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের কুরআনী ঘোষনার সাক্ষ্য দেয়, যেটা আমরা পাকিস্তান রাস্ট্রের সংবিধানেও দেখেছি। এমন ইসলামী রাস্ট্রের নাগরিকদের রাস্ট্রের প্রতি আনুগত্য শর্তাধীন, যা কিনা রাস্ট্রের পাটাতনে দাঁড়িয়ে আল্লাহরই শর্তহীন আনুগত্য করা। আমরা যখন মসজিদে বসে কিবলার দিকে সিজদা দেই, সেই কিবলা বরাবর মসজিদের দেয়াল থাকে। কাজেই তখন এটা বলা যায় না যে আমরা মসজিদ বা এর দেয়ালকে সিজদা দিচ্ছি। এমন বলাটা হাস্যকর। কাজেই ইসলামী রাস্ট্র, নির্বিচারী উপনিবেশী আধুনিক রাস্ট্রের মতো শর্তহীন ভাবে নাগরিকদের উপর চেপে বসতে পারে না। এই রাস্ট্রের উপর আল্লাহর শর্তহীন সার্বভৌম কর্তৃত্ত্ব অটুট থাকে। এতে আল্লাহর হক আদায়ে নাগরিকতা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না, সেটা নির্বিচারী আধুনিক রিপাবলিক বা জাতি রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ঘটে। ইসলামী রাস্ট্র আমাদের মতোই সৃস্ট, তাকে স্রস্টা ভাবা শিরক- এই পর্যন্ত তালাল ঠিকই ভেবেছেন। কিন্তু পাকিস্তান রাস্ট্র এমনটা করেছে বলে ধরে নিয়ে তালাল ভূল করেছেন। আবারো যদি আমরা অব্জেক্টিভস ডেক্লেরেশনের প্রথম লাইন দেখি তাহলে তালালের ভূলটা পরিস্কার হয়।
“Sovereignty over the entire world belongs to Allah Almighty alone”- পাকিস্তান রাস্ট্রের সংবিধানের প্রিএম্বলের প্রথম এই স্বীকার্যে পরিস্কার ভাবে ঘোষিত হচ্ছে, সার্বভৌমত্বের দাবীদার একমাত্র মহান আল্লাহ। এই সার্বভৌমত্বের পরিধি মোটেও নিছকই যে পাকিস্তান না, সেটাও বলা হয়েছে সুনির্দিস্ট ভাবে “over the entire world” শব্দ বন্ধনীতে। যদি এই স্বীকারোক্তি শুধু নির্দিস্ট রাস্ট্র হিসাবে পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব হতো, তবে তা কিভাবে সমগ্র বিশ্বের হবে? তালাল এই দিকটা ধরতে পারেন নাই। আবার পাকিস্তান রাস্ট্র কোন ক্ষমতায়, কি অধিকারে নিজ ভূ-খন্ডের বাইরে কোন কিছুর সার্বভৌমত্ব মেনে নিলো? এমনটা করা গেছে কারন, পাকিস্তান নিজেই মাখলুক রাস্ট্র হিসাবে সার্বভৌমত্বের আধুনিক উপনিবেশিক অহংকার থেকে নিজেকে মুক্ত করার তাজকিয়া সম্পন্ন করে মহান আল্লাহ পাকের সার্বভৌমত্বের চূড়ান্ত সত্যের কাছে নিজেকে সঁপে দিবার ঘোষনা দিতে পেরেছে। বিষয়গুলি খতায়ে দেখলে এটা পরিস্কার হবে যে, জিনিয়ালজিস্ট হিসাবে তালাল নিজ পিতার চিন্তার হিসাব নিতে বসেন নাই। উনি মতাদর্শিক জায়গা থেকেই তা করছেন। শেষ পর্যন্ত আধুনিক লিবারেল রাস্ট্রের মতাদর্শের ভিত্তিই তালালের পর্যালোচনার মূলনীতি। আরো বলা দরকার যে, সার্বভৌমত্ব বিষয়ে কার্ল শ্মিটের চিন্তাকে ইসলামী সার্বভৌমত্বের সাথে মিলে না বলে দাবী করছেন তালাল। তিনি আরো বলছেন শ্মিটখ্রিস্টিয় ইতিহাসকেই বলবৎ করছেন। যদি আমরা কার্ল শ্মিটের সার্বভৌমত্ব তত্ত্ব বুঝে থাকি, তবে এর ভিতর সার্বভৌমত্ব সংক্রান্ত একটা সাধারন নিয়ম বের করতে পারবো। উনার মোটা দাগে যুক্তি হলো শাসন ব্যবস্থা, যাই হোক, যে নামেই তাকে ডাকা হোক, সব সময় যে একদম সাবলিল, ঝামেলাহীন ভাবে চলতে থাকবে, তা নয়। যদি এমন কোন অভাবনীয় মুহুর্ত হাজির হয় যে, বিদ্যমান ব্যবস্থাতে বা প্রচলিত আইনে তার কোনই সমাধান পাওয়া যাচ্ছে না, তখন একে ব্যতিক্রমী অবস্থা বা স্টেট অব এক্সেপশন বলে। যেই ক্ষমতা বলে কোন কিছু বা কেউ এই ব্যতিক্রমী অবস্থাকে বাগে আনতে পারে, অনুকুলে ফেরাতে পারে, তখন সেই শক্তিকেই সার্বভৌম ক্ষমতা বলে। তিনি গোঁড়া ক্যাথলিক মতাদর্শ ত্যাগ করেন যৌবনেই। শ্মিটগবেষক রাফায়েল গ্রস দেখিয়েছেন, স্মিটকে নাস্তিক রাজনৈতিক ধর্মতাত্ত্বিক আকারেই ভালো ভাবে বুঝা সম্ভব। তাহলে তালাল এখানে শ্মিটের তত্ত্ব খ্রিস্টিয় ইতিহাসকে গ্রহন করে বলতে কি বুঝিয়েছেন, তা স্পস্ট না হলেও আমরা শ্মিটের তত্ত্বের সাধারন আকারকে বিশ্লেষনের জন্যে গ্রহন করতে পারি।
সোজা এটুকু বুঝা যায় যে, আধুনিক রাস্ট্র ব্যবস্থায় রুল অব ল বা আইনের শাসনের উপরেও ক্ষমতাধর স্বত্তা থাকতে পারে, আর সেই স্বত্তাই সার্বভৌম। শ্মিটের এই সূত্রানুযায়ী, সার্বভৌম ক্ষমতা প্রেসিডেন্ট, রাজা, প্রধানমন্ত্রী এমন কি অন্য কোন নীতিমালা বা ধর্মতত্ত্ব হতেও কোন বাধা নাই। রক্ত মাংসের মানুষকেই শুধু সার্বভৌম হতে হবে এমন কোন শর্ত শ্মিটের সাধারন নিয়মে অনিবার্য না। সকল সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী আল হাকিমু বা আল্লাহ পাক যদি সসীম মানুষকে চলার জন্যে কোন নীতি মালা প্রনয়ন করে থাকেন, এবং সেই নীতিমালা যদি কেউ বা কোন গোষ্ঠী রাস্ট্রে কার্যকর করতে পারে, তাহলে এই বিশেষ রুপের আধুনিক রাস্ট্রও ইসলামী হতেই পারে। এতে রাষ্ট্রের আধুনিকত্বের তেমন কোন রকমফের ঘটে না। আসাদের পাকিস্তান রাস্ট্রের জন্যে প্রনীত উপদেশ মালায় এমনটাই বলা হয়েছে, “Thus, the real source of all sovereignty is the will of God as manifested in the ordinances of the Shariah. The power of the Muslim community is of a vicarious kind, being held, as it were, in trust from God; and so the Islamic state -- which, as we have seen, owes its existence to the will of the people and is subject to control by them -- derives its sovereignty, ultimate, from God. If it conforms to the Shar’i conditions on which I have dwelt in the preceding pages, it has a claim to the allegiance of its citizens in consonance with the words of the Prophet”। এর পরেও অনেক কথা থাকে। এখানে আমরা মোটা দাগে মুহম্মদ আসাদ এবং তালাল আসাদের বরাতে আধুনিক ইসলামী রাস্ট্রের কাঠামোগত দিক নিয়েই আলাপ তুলেছি। আগেই বলা হয়েছে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের সাক্ষ্য এবং একে মেনে চলার অঙ্গীকারের ভিতর দিয়ে রাষ্ট্র প্রধান শারিয়ার অনুকুলে নিজ দায়িত্ব পালন করবেন। রাস্ট্র প্রধান নিজে সার্বভৌম নন, বরং আল্লাহর সার্বভৌমত্বের প্রধান অনুসারী। তালাল এখানে বলেন, “ইসলামি রাষ্ট্রের প্রবক্তাদের মতে ইসলামি রাষ্ট্রে সার্বভৌমত্বের মালিক মানুষ নয়। স্বয়ং আল্লাহ। এই পরম সত্যই হচ্ছে ইসলামি রাষ্ট্রে পূর্ণ আনুগত্যের মূল ভিত্তি। কুরআনে বলা হয়েছে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সব কিছুই আল্লাহর নিয়মের অধীন। তাহলে কিভাবে মানুষের তৈরী রাষ্ট্র তার নাগরিকদের কাছ থেকে আনুগত্য দাবী করার অধিকার রাখে? ইসলামি রাষ্ট্রের কোন মানব শাসক তো আল্লাহর নাম করে তাঁর বিধান চাপাতে পারে না।“ ইসলামে আনুগত্য একটি অত্যন্ত গুরুত্ব পূর্ন দিক। বিশেষ করে শাসকের প্রতি আনুগত্য। ব্যক্তি জীবনেও সন্তানের জন্যে পিতা মাতার আনুগত্য করা এবং স্ত্রীর জন্যে স্বামীর আনুগত্য করার শর্ত মহান আল্লাহ। অর্থাৎ আল্লাহর জন্যেই আনুগত্য। এটাই আনুগত্যের সাধারন নিয়ম যা শেরেক নয়। তাই ইসলামী রাস্ট্র আনুগত্যের দাবী করাটাই স্বাভাবিক কারন তা ইসলামী মূল নীতিকে বলবৎ করে। এই আনুগত্য করা শেরেক নয়। বিষয়টা খুবই সহজ। বরং উল্টোটা হলেই তা শিরকের শর্ত পূরনের সম্ভাবনা তৈরি করে। মূলত এমন আশংকা থেকেই উপনিবেশী ধারাবাহিকতার আধ্নিক রাষ্ট্রকে ইসলামী করনের প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন ইসলাম পন্থীরা। মুসলিম অধ্যুষিত রাস্ট্র যদি ইসলামী আদর্শের অঙ্গীকার না করে, তবে সেই রাস্ট্রের আনুগত্য করায় শিরকের আশংকা তৈরি করে, যা তালাল উল্লেখ করেন নাই। ইসলামপন্থীরা রাস্ট্র ও আল্লাহকে অভেদ মনে করে ভূল করে বলে তালাল ধরে নেন, যা মোটেও বাস্তব ভিত্তিক নয়।
তালালের মতে, “কিন্তু রাষ্ট্রের পক্ষে কখনোই ইসলামি সার্বভৌমত্ব বলতে যা বুঝায় তা অর্জন করা সম্ভব না। বিশেষজ্ঞরা বলছে ঘটনাক্রমে যেসব অমুসলিমরা ইসলামি রাষ্ট্রে থাকছে তাদের পক্ষে পূর্ণ আনুগত্য করা সম্ভব না। আমি বলছি না তা করা সম্ভব। আমি বরং মনে করি এই ধরনের আনুগত্যের ধারণাটা পুরোপুরি আধুনিক।এর সাখে ইসলামি আদর্শের কোন সম্পর্ক নাই।“ পরিপূর্ন ইসলামী খিলাফাত যদি ইসলামী সার্বভৌমত্বের আদর্শ হয়, তবে আধুনিক রাস্ট্র অবশ্যই পরিপূর্ন ইসলামী নয়। তবে আংশিক বা ইসলাম বিরোধী নয় বা ইসলাম বান্ধব হলেও অসুবিধা নাই। আগেই বলেছিলাম যে, তালাল যদি জিনিয়ালজিকাল পদ্ধতিতে বিষয়টা বুঝতেন তবে ধরতে পারতেন মুহম্মদ আসাদের বাসনার কেন্দ্রে কি আছে? উপনিবেশের কাছে রাজনৈতিক পরাজয়ের পরে সত্ত্বাগতভাবে এলিয়েনেটেড হয়ে যেত মুসলিমরা, যদি ইসলামপন্থীরা অত্যন্ত সৃস্টিশীল সক্রিয়তার ভিতর দিয়ে ইসলামী রাস্ট্রের রুপকল্প হাজির না করতে পারতেন। আসাদের পাকিস্তানের বর্তমান অস্তিত্ত্বই বলে দেয় যে, ঐতিহাসিক ইসলামী আধুনিক রাস্ট্রের অর্জন সম্ভব না বলে তালাল ভূল করেছেন। নাগরিকদের রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্যের ইসলামীকরনের মাধ্যমেই ইসলামী আদর্শের সাথে যে সম্পর্ক তৈরি হয় তা তালাল উপলব্ধি করতে পারেন নাই। তবে অবশ্যই অমুসলিম নাগরিকদের বিষয়টি একটু বিশ্লেষন করার দাবী রাখে। আধুনিক রাস্ট্রের একটা বিশেষ ছক বা রুপ হলো রাস্ট্র প্রধান পদ রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্বের প্রতীক এবং ধর্ম, বর্ন নির্বিশেষে যে কোন নাগরিক এই পদের যোগ্য। অন্যান্য যে কোন আধুনিক রাস্ট্রকে এই ছক গ্রহন করতেই হবে, তা না হলে আধুনিকত্ব থাকবে না, এমন ভাবাটা খুব ভূল। খেয়াল করবেন তালালের ভিতর আধুনিক রাস্ট্রের এই লিবারেল ধারনা প্রায় অন্ধ বিশ্বাসের মতো গেঁথে আছে। ধরা যাক, বৃটিশ রাস্ট্রের কথা যাকে সাংবিধানিক রাজতন্ত্রও বলে অনেকে। এখানে রাজা বা রানী সাংবিধানিক সার্বভৌমত্বের প্রতীক। এখানে রাস্ট্র প্রধান একটি মর্যাদাবাচক পদ। সাধারন নাগরিকদের কেউ যদি রাজা রানীর বংশীয় না হয়, তবে সে কখনো এই ব্যবস্থায় রাস্ট্র প্রধান হতে পারবে না। এতে কি সাধারন নাগরিকদের নাগরিকত্ত্ব ক্ষুন্ন হয়? বংশই এখানে সার্বভৌমত্ত্বের ধারক বাহক। বংশভিত্তিক এই ফিলটার বা ছাঁকুনীর কারনে আমরা কেউ কি কখনো বলতে পারবো গ্রেট বৃটেন আধুনিক রাস্ট্র না? রাস্ট্রীয় আধুনিকতার অন্যতম গুরুত্ত্বপূর্ন ঐতিহাসিক দলিল ম্যাগনা কার্টার উৎস তো এখানেই। ইসলামী রাস্ট্রেও রাস্ট্র প্রধান বা রাষ্ট্রীয় ভাবে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের অনুগত্যকারী মুসলিম হতে হবে। তাতে এখানেও নাগরিকদের আইনের শাসনের সমতা বা সমান অধিকারে হেরফের ঘটে না। এখানে আসাদ মত হলো, অমুসলিম কেউ সরকার প্রধান হতে গেলে তাকে ইসলাম গ্রহনের শর্ত পুরন করতে হতো। তাতে ধর্ম পালনের নাগরিক অধিকার ক্ষুন্ন হতো অমুসলিমদের। তালাল যোগ করেন, “যে রাষ্ট্র কারো নিজস্ব আদর্শের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত নয় সেখানে তারা প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। তাই অমুসলিমদের ইসলামি রাষ্ট্রে প্রতিনিধিত্বের কোন সুযোগ নাই। এখানে আমরা ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাঈলের উদাহরণ দিতে পারি। এই রাষ্ট্রে মুসলিম বা খ্রিস্টানদের কোন প্রতিনিধিত্ব নাই। সেই কারনে নৈতিকভাবে রাষ্ট্রের নিয়মিত কর্মকাণ্ডে তারা অংশ নিতে পারে না। আমি খুব সহজভাবেই বলতে চাই যে ইসলামি রাষ্ট্রেও এর ব্যতিক্রম হওয়ার কথা না।“ কথা হলো, পৃথিবীতে এটা একটা স্বাভাবিক অবস্থা হিসাবে সামাজিক, ভূখন্ডগত ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতা এবং অস্তিত্ত্বের এই শর্ত গুলির নিশ্চয়তা ইসলামী রাস্ট্রের জন্যে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কর্তব্য যার প্রতিশ্রুতি শতভাগ থাকে। নাগরিকেরা সমাজের মতো রাস্ট্রেও ঐক্য বজায় রেখে পরস্পরের চাহিদা, নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। কাজেই ইসলামী রাস্ট্রে নাগরিকদের ঐক্য থাকে না এটা বলা ঠিক না। ঐতিহাসিক ভাবে এই বিষয়ে, আমরা মুহম্মদ আসাদের পাকিস্তানের বরাত দিতে পারি। সেখানে চাকমা রাজা থিদিব রায় বা পাঞ্জাবের শিখরা উল্লেখযোগ্য উদাহরন। আগেই বলা হয়েছে আইনের শাসনের ইনসাফপূর্ন বন্দোবস্ত থাকে। আর নানাভাবে যুগের চাহিদা পূরনে এসব পুনঃর্বিন্যাস করা যায়। এই সহজ বিষয়গুলি তালাল এড়িয়ে গিয়ে নির্বিচার ভাবে বলেন যে, “অমুসলিমদের ইসলামি রাষ্ট্রে প্রতিনিধিত্বের কোন সুযোগ নাই।” আবার ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাঈলের উদাহরণ দিয়ে তিনি তথ্যগত বিভ্রাট ঘটিয়েছেন। ইসরাঈলের সংবিধানে ইহুদী নন, এমন নাগরিকেরাও রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের সূযোগ পান। হাকিমিয়ায়াতের জায়গা ঠিক রেখে ইসলামী রাস্ট্রকে নানা আধুনিক রুপে পূনঃর্বিন্যাস করা যেতে পারে। শক্তিশালী ইসলামী রাস্ট্র পরিগঠনে পুনঃর্বিন্যাসের নানা প্রচেস্টা ইসলামী ধারায় লক্ষ্যনীয়, যা তালালের এই লিখার পরিধিতে আসে নাই।
তালাল এভাবে নিজ দৃস্টিতে আসাদের সমস্যাগুলি তুলে ধরে, ইসলামের আরেক দিক তুলে ধরতে সচেস্ট হন। পিতা হিসাবে আসাদ শিখিয়েছিলেন ইসলামের এই সৌন্দর্য মন্ডিত দিকগুলি যার ভিতরে সামাজিক দাওয়া, আধ্যাতিকতা, আত্মার বিকাশের পথে মর্যাদা ও মঙ্গল ভিত্তিক জীবন যাপন অন্যতম। জগলুল আসাদের প্রবন্ধে এর সুন্দর বর্ননা আছে। “তালাল আসাদ তাঁর পিতার কাছ থেকে Shukr al-munim এর ধারণা লাভ করেন। এই ধারণানুসারে জগতের সবকিছু আল্লাহ মানুষের জন্যে সৃষ্টি করেছেন, চিহ্ন হিসেবে। তাই, স্রষ্টার প্রতি, মহান এই দাতার প্রতি শুকরিয়ার অনুভব জগতের সাথে মানুষকে এক বিশেষ সম্পর্কে আবদ্ধ করে। প্রকৃতি, জীবনোপকরণ,মানবীয় সম্পর্ক সবই আল্লাহর আয়াত বা বিহবল-করা চিহ্ন। এই অনুভবে ঋদ্ধ মানুষ, যাকে মুসলিম নামে ডাকা হয়, সে ক্রমাগত লড়াইয়ে লিপ্ত থাকে পরিবেশ-প্রকৃতি ও সম্পর্কের পণ্যকরণের ( Commoditization) বিরুদ্ধে। আসাদ মনে করেন এই লড়াই খোদার প্রতি অর্থাৎ দাতার প্রতি শুকরিয়া আদায়ের এক পদ্ধতি হতে পারে।“ তালালের মতে রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং রাস্ট্র তৈরির আধুনিক বাসনা থেকে সড়ে গিয়ে, সামাজিক জায়গায় এবং ব্যক্তির জীবনে মারুফ এবং মুনকারের বিষয়ে কর্তব্যের বাস্তবায়নের পথই ইসলামের অনন্য সম্ভাবনা। আমার মনে হয়, আধুনিক যুগে এবং ৯/১১ পরবর্তী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের কালে, এমন উইটোপীয় রাজনীতি বিচ্ছিন্ন সামাজিক আন্দোলন বেশিদূর আগাতে পারে না। দাওয়া ভিত্তিক এই মুসলিম স্বতঃস্ফূর্ততা অবশ্যই ইসলামের অনন্য সুন্দর দিক। আধুনিক কাল বলেই এর পাশে শক্তিশালী রাজনৈতিক অংশগ্রহন দরকার। তবে তালাল উনার প্রবন্ধের শেষের দিকে এসে আবার জিনিয়ালজি পদ্ধতিতে এর বিশ্লেষন সম্পন্ন করেন। জগলুল আসাদের বয়ানে, “ইসলামি রাজনীতি নির্বাচনীয় বিজয়ের (electoral victory) জন্যে দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতা নির্ভর (Competitive) রাজনীতি নয়, বরঞ্চ কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রের অপরিমেয় ক্ষমতার বিরুদ্ধে তা চ্যালেঞ্জ প্রদানকারী। এই অর্থে, ইসলামি রাজনীতিকে জুনিয়র আসাদ বলছেন "কনফ্রন্টেশনাল"। তালাল আসাদের মতে, ইসলামি রাজনীতি রাষ্ট্রের প্রতি পরম আনুগত্যের ধারনাকে মেনে নিবেনা । কেননা, আবসোলিউট লয়ালটি পাবার একমাত্র অধিকারী যদি আল্লাহ হন, তাহলে রাষ্ট্রের হুকুম আহকামের প্রতি প্রত্যকের পরিপূর্ণ আনুগত্য আল্লাহর সাথে শিরকের নামান্তর। এই যুক্তিতে, তালাল আসাদ ইসলামের "আমর বিল মারুফ ওয়া নাহি আন আল মুনকার" নামক হুকুমের সম্মিলিত চর্চা ও সম্পাদন (Collective Performance) কে ইসলামি রাজনীতি হিসেবে দেখবার প্রস্তাব করেন। এই "সৎকাজের আদেশ ও অসৎকাজের নিষেধ" নামক কর্মটি সম্পাদিত হবে রাষ্ট্রের ক্ষমতা ব্যবহার না ক'রে, রাষ্ট্র কর্তৃক কোন শাস্তি বা হুমকির ব্যবহার বা তোয়াক্কা ব্যতিরেকেই। এই কাজগুলো সেকুলারিস্টগণও করে থাকেন, তবে, তালাল বলছেন, তারা তা করে থাকে একটা এথিকাল চয়েস থেকে, বা মোরাল কন্সিয়েন্স থেকে। কিন্তু ইসলামের রাজনীতিতে "আমর বিল মারুফ" অথবা "নাহি আনিল মুনকার" নামক চর্চা কোন ব্যক্তিগত বিবেকবোধের জায়গা থেকে করা হয়না। ইসলামি রাজনীতিতে কর্মের উৎস হবে একটা " Embodied disposition" বা একটা অন্তর্গত ভাবধারা বা ইমানি চেতনা । এই এম্বোডিড ডিসপোজিশনের তিনটি বৈশিষ্ট্য তালাল চিহ্নিত করেছেন তাঁর পিতাকে নিয়ে রচিত এই প্রবন্ধেঃ ১। এইটা ধীরে ধীরে অন্তরের ভেতর চর্চিত হবে, অনুভুতিতে রূপান্তরিত হবে [৯] । ২। এটা ব্যক্তির সার্বভৌমত্বকে প্রত্যাখ্যান করবে( (repudiate the sovereignty of the individual), এটা শক্তি বা কর্তৃত্ব পাবে ইসলামের ডিসিকার্সিভ ট্র্যাডিশিন [১০] থেকে,ব্যক্তির ইচ্ছা-অনিচ্ছার খামখেয়াল থেকে নয়। ৩। এই ইমানি চেতনা পরিবেশের পণ্যায়ন, অর্থনীতি ও মানবীয় সম্পর্কের পণ্যকরণের বিরুদ্ধে লিপ্ত থাকবে নিরবিচ্ছিন্ন সংগ্রামে।“ লক্ষণীয় বাংলাদেশে ইসলামী সংগঠন হেফাজতে ইসলাম ঠিক এই অর্থেই অরাজনৈতিক। সমকালীন জাতীয় ইতিহাস পর্যবেক্ষন করলে বুঝা যায়, জাতীয় পর্যায়ে ক্ষমতার প্রতিনিধিত্বে সংগঠনটি বিকশিত না হওয়ায়, রাস্ট্রিয় ক্ষমতার চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হলে এর কার্যক্রম অনেক সীমিত হয়ে পরে। ফলে সিভিল বা রাজনৈতিক সোসাইটির সাথে প্রতিযোগিতায় তা অনেক সময়েই ব্যর্থ হয়ে পরে। আধুনিক রাস্ট্র ডিসিপ্লিনারী ক্ষমতা যেই পদ্ধতিতে চর্চা করে, তাতে হেফাজতের মতো আন্দোলনগুলির জন্যে টিকাই মুশকিল যদি না তার সমান্তরালে শক্ত ইসলামী রাজনৈতিক আন্দোলন না থাকে। তালালের এই নসিহা কিন্তু নতুন না। ইসলামের ভিতরেও রাজনীতি বিমুখতার সক্রিয় ধারা আছে। তবে তালাল বর্নিত এই বিশেষ ধারা ইসলাম্পন্থা বিরোধী নয়। তাদের যাপনের ভিতর আধুনিক অর্থে রাজনৈতিকতার চর্চা সীমিত হলেও, কেউ যদি মতাদর্শিক ভাবে রাস্ট্র ক্ষমতা বরাবর রাজনৈতিক আন্দোলনে সফলতা দেখাতে পারে তবে, এরা তার বিরোধী হবেন না বরং সহগামী হবেন। তালাল ইনাদেরকে ইসলামী ডিস্কার্যিভ ট্রাডিশনের অন্তর্গত মনে করলেও, ইসলামপন্থী রাজনৈতিক ধারার ক্ষেত্রে তা বলতে পারেন নাই। এখান থেকে বলা যায়, তালাল ইসলামের আধুনিক রুপের ঐতিহাসিক সক্রিয়তা পরিপূর্ন বিচারে ব্যর্থ হয়েছেন।
পরিশেষে, আবার আমরা শ্মিটের দ্বারস্ত হতে পারি। শ্মিট লক্ষ্য করেছেন যে, রাস্ট্র এবং সার্বভৌমত্বের এই কাঠামো মূলত ধর্মনিরপেক্ষতার বাতাবরনে ধর্মতাত্ত্বিক প্রকল্প। রাস্ট্র যে বিধানদাতা, এটা ধর্মীয় সত্যরই নিধর্মকৃত রুপ। শুধু তাই নয়, এর কাজ শুধু অতীত ব্যবস্থাকে সরিয়ে একই জায়গায় নিজেকে স্থাপন করা। রাস্ট্র যে জরুরী অবস্থায় হস্তক্ষেপ করতে পারে, এটা সৃস্টিকর্তার অলৌকিক ঘটনা ঘটানোর ক্ষমতাকে স্থানান্তর করে মাত্র, যা তালালও উল্লেখ করেন। সৃস্টিকর্তা বিশ্ব জাগতিক যে কোন ঘটনার সিদ্ধান্ত গ্রহনকারী। কোন কিছু কখন কিভাবে ঘটবে, কিভাবে শেষ হবে সব কিছু নিয়ন্ত্রন কারী এবং এতে একমাত্র হস্তক্ষেপকারী। আধুনিক রাস্ট্রও তেমন একই ক্ষমতা তার বলয়ে প্রয়োগ করতে চায়। শ্মিট আরো খেয়াল করেছেন যে, সাংবিধানিক লিবারেল রাস্ট্রগুলি মূলত সৃস্টিকর্তার ভূমিকা নিতে চায়। আমেরিকা যুক্তরাস্ট্রের সংবিধান রচনার সময়ে রচয়িতারা জগতের ব্যাখ্যায় আলৌকিকতাকে এড়িয়ে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির ভিত্তিতে দুনিয়াদারির প্রতিষ্ঠা করতে যাবার প্রচেস্টার ভিতর দিয়েই আধুনিক মার্কিন রাস্ট্রের সূচনা করেন। বুদ্ধিবৃত্তির ভিত্তিতে রাস্ট্র করলে সেই রাস্ট্রের আর আলাদাভাবে দুনিয়াবি ব্যাখ্যার জন্যে ধর্মের দরকার হয় না। স্মিট নিরাসক্ততার সাথেই এই ইতিহাস পাঠ করেছিলেন বলেই বুঝতে ভূল করেন নাই যে, যত চেস্টাই করুক এই “সার্বভৌমকে” বাদ দিতে পারে নাই লিবারালিজম। কাউকে না কাউকে ক্ষমতায় থেকে জরুরী বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতেই হবে, কাউকে না কাউকে অবশ্যই সেই মীমাংসার ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হবে। এই সত্য লিবারেলিজম লুকাতে পারে নাই অনেক পর্দায় সত্যকে আচ্ছাদিত করেও। এমনই একটা পর্দা যেমন জনগন সার্বভৌম বলে লিবারেলইজমের দাবী। লিবারেল এই লুকাচূড়িকে সহজেই উন্মূক্ত করে দেয় ইসলামপন্থা। তাকে নতুন করে সুবিন্যস্ত করে রাস্ট্রের কাঠামোতেই। বুদ্ধিবৃত্তিক বন্দুকের নল ঘুড়িয়ে দেয় লিবারেলিজমের দিকেই। এভাবে হাকিমিয়াতের সীল মোহর মেরে দেয় রাস্ট্রের মর্মে। একথা সত্য যে এতে আধুনিকতার বিলয় ঘটে না। তবে তার উদ্ধত অহংকারের খাৎনা করানো যায়। সিম্বায়োটিক রাজনৈতিক কমুউনিটি গড়ে উঠার পথ প্রসস্ত হয়। ওয়াল্টার মিগনোলো ডিকলোনিয়াল সৌন্দর্যতত্ত্বের (decolonial aesthetics) এর প্রসঙ্গে এক গুরুত্ত্বপূর্ন আলাপে বলেছিলেন, প্লেটোর রিপাবলিক বা এরিস্টটলের পলিটিক্স দিয়ে কোন মিল্লেনারিয়ান চৈনিক রাজা কি করবেন? উপনিবেশবাদ আর আধুনিকতা হাত ধরাধরি করেই চলে। ইসলাম পন্থিদের ভিতর লিবারেলিজম প্রভাবিত যেই হীনমন্য ধারা গড়ে উঠেছে, যেই ধারা নিজেই নিজের সম্পর্কে সন্দিহান তাদের চোখ ধাঁধিয়ে আছে লিবারেলিজমের গ্ল্যামারে। তারা এই জাঁকজমকে হতবুদ্ধি, নির্বাক। মুহম্মদ আসাদের মতো আধুনিক মুসলিম যেখানে মাওলানা সাব্বির আহমেদ উসমানীর ধারার সাথে মিশে ইসলামের জন্যে কাজ করে গিয়ে প্রমান করেছেন যে তিনি আধুনিক বুদ্ধিবাদী হয়েও এমন রাজনৈতিক প্রকল্পে কাজ করতে পারেন, যা আধুনিক কিন্তু লিবারেল না। যেমন পাকিস্তান একটি আধুনিক ইসলামী রাস্ট্র হলেও, তা মোটেও পাশের আধুনিক ইন্ডিয়া রাস্ট্রের মতো না। মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় উপনিবেশের নির্বিষকরনের প্রথম ধাপই ইসলামী রাস্ট্র। এই বিষমুক্তি ঘটলেই মানুষ দেখতে পায় নতুন পৃথিবীর সৌন্দর্য। এমনটাই ছিল মুহম্মদ আসাদের স্বপ্ন ও জীবন।
বরাতঃ
১. Cheema, Shahbaz Ahmed. Problematizing Basis of Mawdudi's Political Theory. University of Punjab, Lahore, Pakistan
২. Hussain, Sayed Adnan. Negotiating Pakistan : A Genealogy of a Post-colonial Islamic State
৩. Carl schmitt and The Jews : The Jewish Question, the Holocaust and the German Legal Theory, Madison : University of Wisconsin Press, 2007:97
৪. Asad, Muhammad. Principles of State and Government in Islam
৫. Asad, Talal. Mohammad Asad between Religion and Politics
৬.শাহ মোহাম্মদ ফাহিমকৃত তালাল আসাদের নিবন্ধের আংশিক অনুবাদ ও জগলুল আসাদের "তালাল আসাদের বয়ানে মুহাম্মদ আসাদ : পিতা পুত্রের মোলাকাত ও মোকাবিলা