কানার হাটবাজার: শাহবাগ ও খারিজি রাজনীতি

By Abdur Rahman Bari

স্বাধীনতা বা একাত্তর উত্তর বাংলাদেশে শাহবাগ আন্দোলন ও শাহবাগের প্রতিরোধ সরুপ শাপলার আন্দোলন ছিল ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ৷ শাহবাগের তাত্ত্বিক, বয়াতি, কুতুবেরা শাপলার আন্দোলনকে নানা ছকে বুঝবার চেষ্টা  চালিয়েছে৷ ফলে শাহবাগের আধিপত্যবাদী ডিস্কোর্সে শাপলা হাজির হয়েছে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি, মৌলবাদ, সুবিধাবাদী, ফ্যাসিস্ট, অশুভ সাব ওল্টার্ন সহ ম্যাস ম্যানিপুলেশনের ফসল হিসাবে। শাপলার আন্দোলন নিয়ে তাত্ত্বিক , বয়াতি এই মহাজনেরা যে ছক প্রস্তাব করে তা ঘুরেফিরে গুজব ও ম্যাস ম্যানিপুলেশন।   সাব ওল্টার্ন কনশাসনেসের জায়গায় কেউ কেউ দেখবার চেষ্টা করেও, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমেত জাতীয়তাবাদের আফিমে বুদ হয়ে থাকায় তা আর দেখবার মওকা হয়ে উঠে নাই৷ শাপলার আন্দোলনকে মার্ক্সবাদী ছক তথা শ্রেনী সংগ্রাম - উৎপাদন সম্পর্ক দিয়ে বুঝা যায় না। এই নিবন্ধে শাহবাগের তাত্ত্বিক,  বয়াতিদের চোখে শাপলার আন্দোলনের মানে বুঝবার কোশেশ করব৷ শাপলার আন্দোলনের কুলুজির সুলুকসন্ধান ও তার সাপেক্ষে উক্ত বয়াতিদের চিন্তা ও তৎপরতা বিচার নিবন্ধের অন্যতম বাসনা৷ নিবন্ধে ৭২ এর কামালবাদী সংবিধান, ইসলাম, ইসলামপন্থা, ৭৫ এর পট - পরিবর্তন ও জিয়ার রাজনীতি ও কথিত সংবিধানে ইসলামিকরণ সংক্রান্ত কিছু মৌলিক প্রশ্নের উত্তর হদিস করব৷  বাংলাদেশের রাজনৈতিক,  সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে যে সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং করবার প্রস্তাব শাহবাগের ছিল তা তলব করব৷ এই নিবন্ধ আধিপত্যবাদী বয়ানের সমান্তারালে চলা অবদমিত বয়ান হাজির করতে যাচ্ছে যা  রাজনৈতিক বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্মাণের প্রস্তাব করে৷

১.শাপলা: ইমানের নিশান

শাহবাগের মহাজনদের আয়নায় শাপলার আন্দোলন ধরা পড়ে কিছু গথবাধা শব্দে। এই মহাজনদের মাঝে অন্যতম কথাসাহিত্যিক, প্রথম আলোর কলামিস্ট ও  চিকিৎসা নৃবিজ্ঞানী শাহাদুজ্জামান। শাহাদুজ্জামানের উৎপাদিত তথ্য, তত্ত্ব ও আলাপচারিতা যা শাহবাগ ২০১৩ নামে বই হিসাবে প্রকাশ পায়৷ উৎপাদিত তথ্য, তত্ত্ব, আলাপচারিতা , চিন্তা ও তৎপরতার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় শাপলার এই গন আন্দোলনকে উনি সাম্প্রদায়িক ও বর্বর হিসাবে পাঠ করছেন৷ একই সাথে গুজব ও ম্যাস ম্যানিপুলেশনের বাহারি তত্ত্বের সমাহারে দেখাচ্ছেন যে এই আন্দোলনে শুধুই বিএনপি  জামাতের রাজনৈতিক প্রকল্পের অংশ বৈ কিছু না।  ৫ ই মে শাপলাতে রাষ্ট্রের আয়োজনে নিজ জাতির সিভিলিয়ানদের গনহত্যাকে  তিনি রাষ্ট্রের উপায় ছিল না বলে উল্লেখ করেন। যদিও পরে নাগরিক অধিকারের দোহাই দিয়ে মৃদ্যু নিন্দাসূচক মন্তব্যও করেন৷ শাহবাগ ও শাপলা সংক্রান্ত শাহাদুজ্জামানের পঠন-পাঠনে দৃশ্যপটে হাজির ছিল তৈমুর রেজাও। শাপলাকে বুঝবার তাগিদে  শাহাদুজ্জামান ও তৈমুর রেজা সাব ওল্টার্ন কনশাসনেস ধারণা নিয়ে আলাপচারিতায় মশগুল হয়৷ জামান আগ্রহী না হলেও ৫ই মে এর পরে তৈমুর মুসলিম মুভমেন্ট গুলোর হিস্ট্রি নিয়ে আগ্রহী ছিল৷ এই আগ্রহ আর বেগবান হয়ে উঠল না। গৌতম ভদ্রের ইমান ও নিশানের দোহাই দিয়ে তৈমুর সাব ওল্টার্নের সুবিধাবাদী প্রবনতা স্মরণ করিয়ে দেয়। ধর্মভাবের (Religiosity) পাটাতনে দাঁড়িয়ে অতীতের সাব অল্টার্নের আন্দোলন স্কীকার করে৷ তবে তৈমুরের তফসিরে সাব ওল্টার্ন যে অশুভবুদ্ধির তথা সাম্প্রদায়িক হইতে পারে, তা সরলীকরণ ই বটে!  শাপলার আন্দোলন বুঝতে তৈমুর গৌতম ভদ্রের ইমান ও নিশানের দারস্থ হয়েও কেন আন্দোলনের চরিত্র বুঝতে বিফল হল , তা অনেকের কাছে আশ্চর্যজনক হলেও অবাক হবার কারন নাই ৷ আদিত্য নিগম তার "Fascism, The Revolt of The 'Little Man' and Life After Capitalism." আর্টিকেলে মার্ক্সীয় মনঃসমীক্ষক উইলহেল্ম রাইখের "ক্ষুদে মানব" ধারণা দিয়ে অপরায়নের শিকার দাসের কর্তা আকারে ফেরবার মুহূর্তকে কর্তৃত্ত্বের কামনা ও বিদ্রোহী সত্তার ভেতর দিয়ে দেখবার চেষ্টা করছেন। শ্রেণী বিবেচনায়  সাব ওল্টার্ন হলেও, রাইখের দোহাই দিয়ে আদিত্য নিগম  এদের বিদ্রোহী সত্তাকে অশুভবুদ্ধির সাব ওল্টার্ন হিসাবে চিত্রায়িত করে৷ ভারতীয় সাব ওল্টার্ন জনগোষ্ঠীর সাথে হিন্দুত্ববাদের যোগাযোগ নিয়ে নিগম বলেন যে, "বিদ্রোহী ও কর্তৃত্ত্বকামী এমন চরিত্র গন আন্দোলনগুলোও প্রকাশ করে৷ " আদিত্য নিগম আরেক মার্ক্সীয়ান মনঃসমীক্ষক এরিক ফ্রমের বরাতে মনে করিয়ে দেয় এই প্রবণতা হলো "Longing for submission ( নতি স্বীকারের সাধ) " ও "lust for power (ক্ষমতার লালসা)৷ "

"rebelliousness combined with a craving for authority are also characteristics that fascist mass movements exhibit. Another Marxist psychoanalyst, Erich Fromm calls this character-feature a ‘longing for submission’ and the ‘lust for power’.

মার্ক্সীয়ান মনঃসমীক্ষক ও আদিত্য নিগমের তত্ত্বীয় বুনিয়াদে দাঁড়িয়ে শাহবাগের মহাজনেরা শাপলার গন আন্দোলনকে ফ্যাসিবাদী বা সাম্প্রদায়িক বলে চিত্রায়িত করে। শাপলার গন আন্দোলন শ্রেণী বিবেচনায় নিম্মবর্গের অংশ গ্রহন থাকবার পরেও, মার্ক্সীয়ান মনঃসমীক্ষক ও আদিত্য নিগমের ছকে তা নাজি বা হিন্দুত্ববাদের ন্যায় হয়ে ওঠে। জামান ও তৈমুর সেই একই ছকে দেখেছেন। তত্ত্বীয় ছক অনুযায়ী জামান ও তৈমুরের নিকট শাপলা হয়ে ওঠে  অশুভ সাব ওল্টার্নের সাম্প্রদায়িক আন্দোলন!জামান, তৈমুর হতে সলিমুল্লাহ খান সহ শাহবাগের সকল মহাজনের বুনিয়াদি ছক এটাই। অশুভবুদ্ধির সাব ওল্টার্ন তত্ত্বীয় কাঠামোর আড়ালে প্রকাশ পায় মুসলিম রাজনৈতিক কর্তাসত্তা ( Muslim political subjectivity)  খারিজের বাসনা৷

গৌতম ভদ্র তার মশহুর বহি ইমান ও নিশানের শেষ প্রবন্ধ যা নাড়কেলবেড়ে জঙ নামে মুসাবিদা করেছেন৷ গৌতম ভদ্র তিতুমীর তথা হিদায়েতিদের আন্দোলন বুঝবার কোশেশ করে দেখছেন যে,  উদারনৈতিক প্রগতিশীল ও মার্কসবাদী ছক ব্যবহার করে আন্দোলনের চরিত্র - বাসনা বুঝা যায় না৷ হিদায়েতিদের আন্দোলনের সাথে উৎপাদন সম্পর্কের যোগাযোগ নাই, যেমনটা ফরায়েজিদের সাথে কিঞ্চিৎ হলেও ছিল। তিতুর তথা হিদায়েতিদের আন্দোলনের ভরকেন্দ্র ছিল সত্তার প্রশ্নে৷ তিতুর তথা হিদায়েতিদের আন্দোলনের ন্যায় শাপলার আন্দোলন শ্রেণী সংগ্রাম ছক দিয়ে বুঝা যায় না, এখানেও আন্দোলনের ভরকেন্দ্র উৎপাদন সম্পর্ক বা জমির মালিকানা সংক্রান্ত না৷ শাহবাগের ব্লগাররা যখন নবীর শানে গোস্তাখি করে তখন আন্দোলনের সূত্রপাত হয়, তদ্রুপ  হিদায়েতিদের মসজিদ পুড়িয়ে ফেলা ও দাড়ির উপর বিশেষ করের কারনে আন্দোলন ঘটেছিল। অর্থাৎ উভয় আন্দোলনের মাকাসিদ অভিন্ন যা সত্তার প্রশ্নে জড়িত৷  দুই আন্দোলনের বাসনাও অভিন্ন৷ তিতুর তথা হিদায়েতিদের আন্দোলন খোদার জমিনে খোদার বাদশাহি প্রতিষ্ঠা করতে ফরমান জারি করেছিল যা হাকিমিয়্যা তথা আল্লাহর সার্বভৌমত্বের ঘোষণা। তদ্রূপ একইভাবে শাপলার আন্দোলনে ১৩ দফার পয়লা দফাতেও সংবিধানে আল্লাহর উপর পূর্ন আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন তথা হাকিমিয়্যা কায়েমের প্রস্তাব করা হয়েছিল যা তিতুর তথা হিদায়েতি আন্দোলনের সাথে বাসনাগত ঐক্যের চিহ্ন। এই চিহ্ন ও ভাষাকে উপেক্ষা করে জামান ও তৈমুরের যে পঠন - পাঠন আমরা দেখি তা জাতীয়তাবাদী আফিমের দৈন্য দশা বৈকি। শাপলার আন্দোলনের শক্তি রক্ত, বংশ ও সম্প্রদায়ের  নিক্তিতে মাপবার জো নেই, যেমন তিতুর তথা হিদায়েতিদের আন্দোলনকেও একই নিক্তিতে মাপবার উপায় নেই৷

"রক্ত, বংশ, পরিবার, সম্প্রদায় তাদের শক্তির উৎস মনে হলেও নিক্তিতে উক্ত হিদায়েতিদের শক্তি মাপবার জো নেই, তাই তাদের শক্তির উৎস খুজতে হবে তাদের ঈমানে এবং আত্ম চৈতন্যের ফলে তৈরি হওয়া তাদের নয়া ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষায়"[গৌতম ভদ্র]

তিতুর তথা  হিদায়েতিদের আন্দোলনের ন্যায় শাপলার আন্দোলনে সকল ধারা - উপধারার মানুষ সামিল হয়েছিল যা গন আন্দোলনে পরিণত হয়েছিল। তিতুমীর তথা হিদায়েতিদের সাথে বাঁশের কেল্লায় যোগ দিয়েছিল মিসকিন শাহ সহ বুরহানা ফকিরেরা, তদ্রুপ শাপলায় হেফাজতে ইসলামের সাথে যোগ দিয়েছিল সাধারণ জনগন, ভিন্নমতের রাজনৈতিক দলের কর্মীরা৷ শাপলার আন্দোলনের কুলুজির হদিস করলে দেখা যায় তরিকা - ই মহম্মদীয়া, সিপাহি বিদ্রোহ, ফরায়েজি আন্দোলন,খিলাফত আন্দোলনের ইতিহাস। একইভাবে  গৌতম ভদ্র হিদায়েতিদের কুলুজির হদিস করে দেখিয়েছেন যে এই আন্দোলন হঠাৎ করে আসমান হতে নাজেল হয় নাই। হারলান পিয়ারসনের বরাতে বলা যায় মুসলিম আত্ম চৈতন্যের সাপেক্ষে তরিকা ই মহম্মদীয়ার আন্দোলন হলো সূচনালগ্ন যা হিদায়েতি হয়ে ইতিহাসের সিলসিলায় শাপলায় বর্তমান। হিদায়েতি ও শাপলার আন্দোলনের কুলুজিও অভিন্ন৷ উভয় আন্দোলনের বুনিয়াদ হইলো ইমান ও মুসলিম রাজনৈতিক কর্তাসত্তা৷ ফলে নানা চটকদারি ছকে ব্যখ্যা করলে রাজনৈতিক কর্তা আকারে হিদায়েতি ও শাপলার আন্দোলনের মর্ম সংকুচিত হয়। সংকুচিত হবার দিকটা গৌতম ভদ্র স্কীকার করেছেন৷

"শাহ ওয়ালিউল্লাহ, আব্দুল আজিজ, সৈয়দ আহমেদ শহিদ আর শাহ ঈসমাইলের ঐতিহ্যে পুষ্ট হিদায়েতিদের আন্দোলন। গ্রাম সমাজে কৃষক আর জমিদারের সরাসরি মোকাবিলার চৈতন্যে তিতুর আন্দোলন অনুপ্রাণিত হয় নি৷ বরং গ্রামের চিরন্তন কায়েমি সম্পর্ক এবং নতুন গড়ে ওঠা হিদায়েতিদের ইচ্ছা আর ক্ষমতা এবং নতুন পরিচয়ের আকাঙ্ক্ষার দন্ধের মধ্যে তিতুর তথা হিদায়তিদের আন্দোলনের জন্ম হয়েছে৷ গ্রামসমাজের সব পরিচিত কুশীলবরাই এসেছে কিন্তু পালার সংলাপ আলাদা৷ তিতু তথা হিদায়েতিদের জমিদার আর কৃষকের সংগ্রামের সরাসরি ছকে ফেললে পালাটা জমবে না। হারিয়ে যাবে তিতুমীর তথা হিদায়েতিদের রাজনীতির জোর, মার খাবে তার দীনের তত্ত্ব।"[গৌতম ভদ্র]

২. শাহবাগ ও কানার হাটবাজার

জামান ও তৈমুর রেজা সাব ওল্টার্ন স্টাডিজের সদস্যবৃন্দের আস্থাভাজন হবার পরেও শাপলায় যে ইমানের নিশান দেখা দিল তা কেন দেখেও দেখতে পেল না!  লালনের গানের সুরে বললে,শাহবাগ কি তাহলে কানার হাটবাজার? শাহবাগকে কানার হাটবাজার বললে অত্যুক্তি হবে না। কেন শাহবাগকে কানার হাটবাজার বললে অত্যুক্তি হবে না, তা বুঝবার আগে ইতিহাসের নানা অলিগলির সন্ধান করতে হবে।ইতিহাসের অলিগলির সন্ধানে মার্ক্সীয় মানচিত্র তথা ছক ব্যবহার করা যেতে পারে৷ মার্ক্স তার" A Contribution to the critique of Hegel's philosophy of right " এর শুরুতেই কহেন যে জর্মন দেশে ধর্মের পর্যালোচনা শেষ হয়েছে এবং ধর্মের পর্যালোচনা হইলো যেকোনো পর্যালোচনার পূর্বশর্ত। মার্ক্সীয় ইতিহাসবীক্ষায় ধর্ম ও সংস্কৃতির পর্যালোচনাও যে আর্দশের বিচার,  তা উপেক্ষা করে শাহবাগের তাত্ত্বিক - বয়াতিরা শাপলাকে সাম্প্রদায়িক - ফ্যাসিস্ট বলে বসলো! দুঃখজনক হলেও সত্যি এই মহাজনেরা নিজেদের মার্ক্সবাদী তথা বিপ্লবি বলতেও বেশ পছন্দ করেন৷ মার্ক্সীয় ছকের নানা রুপের আমল ও তারা বেমালুম হইয়া গেল! ফ্রেদরিখ এঙ্গেলস "জার্মানীর কৃষক বিদ্রোহ " বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে শ্রেনী সংগ্রামও ধর্মীয় মোড়কে হইতে পারে। শাপলার আন্দোলনকে জামান ও তৈমুর ধর্মীয় মোড়কে শ্রেণী সংগ্রামের জায়গা থেকেও দেখতে ব্যর্থ হয়েছে। যদিও দেখলেও পুরো ফায়দা ছিল না, কারন এই আন্দোলন যে ধর্মীয় মোড়কে শ্রেনী সংগ্রাম নয় তা ভদ্রের আলাপ হতে স্পষ্ট। কিন্তু কম হলেও ত একজন কথিত মার্ক্সবাদী মার্ক্সীয় এই ছকে বুঝবার চেষ্টা করবে! জামান - তৈমুর সেই পথে হাটেনি। মার্ক্স ও এঙ্গেলসের তত্ত্বীয় আলাপের বাইরে থেকেও যদি বাস্তবতার নিরিখে রাজনৈতিক সংকট, আন্দোলন, বিপ্লব, ইসলাম ও মুসলিম জনগনের সাথে সম্পর্কের জায়গা থেকে জামান ও তৈমুর বলশেভিকদের অনুসরণ করত তাও সাত খুন মাপ করা যেত! বরং তারা বলশেভিকদের উল্টো পথে চলেছেন। বলশেভিকদের সাথে চেচেন এবং ককেশাস অঞ্চলের মুসলিমরা শুধু যেমন যুদ্ধ করে নাই, বরং পারস্পরিক মিত্রতা ও সহযোগিতার নজিরও ইতিহাসে যে আছে পৌছেছিল, তা হয়ত জামান - তৈমুরের নজরে পড়েনি। সোভিয়েত কেন্দ্রীয় আইনের সমান্তারালে মুসলিম অধ্যুষিত ককেশাস, দাগিস্থান ও চেচনিয়াতে শারিয়া আইন চলেছিল, তা তাদের অগোচরেই রয়ে গেছে [Crouch] এই অগোচরে রয়ে যাওয়ার শানে নুযূল কি? সন্দেহাতীত ভাবে উগ্র সেক্যুলারবাদ তথা কামালবাদ। বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও ইসলাম সংক্রান্ত বোঝাপড়া করতে গিয়ে জামান ও তৈমুর খিলাফত উত্তর নব্য তুরস্কের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিসর সামনে এনে দাবি করেন যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মলগ্নে কামাল আতাতুর্কের মতোন ধর্মীয় যাপনের বিরোধিতা করা হয় নাই৷ এই দাবি প্রমান করে  মতাদর্শ এবং পলিসি হিসাবে কামালবাদের বিকাশ, পথচলা ও বিবর্তিত সুরত ধরতে জামান ও তৈমুর ব্যর্থ হয়েছে৷ বিলাতের লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের মশহুর ওস্তাদ সালমান স্যায়িদ স্যায়িদ ইতিহাসের একটু পিছনে ফিরে খিলাফত উত্তর নব্য তুরস্কের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং মতাদর্শের কুলুজি ধরার কোশেশ করেছেন।স্যায়িদ তার "A Fundamental Fear Eurocentrism and The Emergence of Islamism"কিতাবে তফছির করেন যে কামালবাদ শুধু তুরস্কের স্থানীয় ফেনোমেনন নয়।উনি "The Impact of Kemalism"অংশে দেখান কামালবাদ ইডিওলজি ও পলিসি হিসাবে মুসলিম জাহানের বহু ভূখন্ডে গৃহীত হচ্ছিল।মুসলিম জাহানের ভূখণ্ডে কামালবাদের প্রভাব নিয়ে বলতে গিয়ে ইরানের রেজা শাহ পাহলভী, আফগানিস্তানের আমানউল্লাহ, ইন্দোনেশিয়ার সুর্কণ, মিশরের জামাল আবদেল নাসেরের প্রসঙ্গ হাজির করেন৷ সকলে আইডিয়া ও পলিসি হিসাবে কামালবাদ গ্রহন করেছিল৷ মুসলিম ভূখন্ডের শাসকদের কামালের পলিসি নিয়ে ছিল মুগ্ধতা। অপরদিকে ঔপনিবেশিক  বাংলায় ছিল কামালবাদের জয়জয়কার। নজরুল হতে কাজী আব্দুল ওদুদ, আবুল হুসেন, নাসিরউদ্দিন, ইব্রাহিম খাঁ, বন্দে আলি মিয়া, সাদাত আলি আখন্দ সহ তৎকালীন সাময়িক পত্রে তার নজির মেলে। কামালবাদ মনে করে ইসলাম প্রভাবিত সমাজে মুসলিম নয় বরং জাতীয়তাবাদী চিন্তা ই কর্তাসত্তার বাহন হতে পারে৷ জাতীয়তাবাদী উগ্র সেক্যুলারবাদে ইমান আনা সমাজের চোখে মুসলিম রাজনৈতিক কর্তাসত্তা চক্ষুশূল হয়৷ চক্ষুশূলতার নজির মিলে একাত্তরের গন্ডগোল বা  স্বাধীনতার উত্তর সময়ে আইন করে সকল ধারার ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার মধ্য দিয়ে  মুসলিম রাজনৈতিক কর্তাসত্তার অপরায়ন ও অবদমন করতে বাধ্য করায়। এই অপরায়নকে আড়াল করতে নানা চটকদারি শব্দের আশ্রয় নেওয়া হয়৷ জামান ও তৈমুর অন্য আট- দশজন বাঙালি সেক্যুলার জাতীয়তাবাদীদের মতোন একই চটকদারি পদ্ধতি ব্যবহার করেছে বৈকি!  জামান ও তৈমুর হয়তো ভুলে গেছে দুনিয়ার কোথাও আইন করে ধর্মকে নিষিদ্ধ করা যায় না।জামান ও তৈমুর চাইলে "On the Jewish Question " এ মার্ক্স ও ব্রুনো বাউয়ের বাহাসের আলাপে চোখ বুলাতে পারতেন। চোখ বুলালে হয়তো খেয়াল করত তাদের রাষ্ট্র বাসনা ব্রুনো বাউয়ের রাষ্ট্র বাসনার ন্যায়! ব্রুনো বাউয়ের মনে করেন ধর্মীয় যে সকল ব্যাপার স্যাপার যা মানুষের মাঝে বিচ্ছিন্নতা তৈরি তা হতে সমাজকে মুক্ত করবার নিমিত্তেই রাষ্ট্রকে সেক্যুলার হয়ে উঠতে। অপরদিকে মার্ক্স কহেন ধর্ম থেকে রাজনৈতিক মুক্তি মানুষের ধর্ম হতে চুড়ান্ত মুক্তি নয়।বাউয়ের রাষ্ট্রের ধার্মিক চরিত্র ও ধর্মকে সমাজ থেকে মুক্ত করবার জন্য রাষ্ট্রের ক্ষমতার ভরকেন্দ্রের দিকে জোর আরোপ করেন, যেখানে মার্ক্স সুরাহা খুজতে জোর আরোপ করেন নাগরিক সমাজ ও অর্থনৈতিক শক্তির ওপরে। তাই ধর্মকে নিষিদ্ধ করলেও তা যাপিত জীবনে থেকে যায় যা তুরস্কেও ছিল। নব্য তুরস্কের মামলায় জামান ও তৈমুর যে বিষয় টা এড়িয়ে গেছে তা হলো রাষ্ট্র হতে ধর্মকে বল প্রয়োগে বিচ্ছিন্ন করা, ধর্মকে নতুন উপায়ে সংজ্ঞায়িত করা ও ধর্মকে নিয়ন্ত্রণ করা৷ ওয়ায়েল হাল্লাক যেটাকে রাজনৈতিক ধর্মতত্ত্বের (Political Theology)  বুলিতে রাষ্ট্র দিয়ে খোদাকে হত্যা করা বলে অভিহিত করেছে৷ হাল্লাক সেক্যুলারইজমের নিয়ে বলতে গিয়ে বলেন যে সেক্যুলারইজম ধর্মীয় জীবনকে শুধু ব্যক্তিগত পরিসরে বন্দী করার নাম নয়, বরং ব্যক্তিগত পরিসরে বন্দী করার সাথে সাথে রাষ্ট্রের খোদাগিরি করা যে কোনটা ধর্ম আর কোনটা ধর্ম না।

"চলেন আমরা সেক্যুলারইজমকে ইয়াদ করি। ধর্মীয় জীবনকে শুধু ব্যক্তিগত পরিসরে বন্দী করার নাম সেক্যুলারইজম না। বরং সেক্যুলারইজম হইলো ধর্মীয়তাকে ব্যক্তিগত পরিসরে বন্দী করার সাথে সাথে রাষ্ট্রের খোদাগিরি করা যে কোনটা ধর্ম আর কোনটা ধর্ম না, কোথায় ও কিভাবে এইটার চর্চা হইবো৷ রাজনৈতিক ধর্মতত্ত্বের বুলিতে,সেক্যুলারইজম রাষ্ট্র দিয়া খোদারে খুন করে৷ রাষ্ট্রের ক্ষমতা আছে যেকোনো ধর্মীয় চর্চার ওপর খবরদারি, খারিজ ও সংকোচন করার এবং উপযুক্ত  ধর্মীয় পরিসরের মান ও পরিমান ঠিক কইরা দেওয়ার।"[হাল্লাক ]

জামান ও তৈমুর এক সিনক্রেটিক বা তথাকথিত লোকায়ত ইসলামের ব্যাপারে আগ্রহী যেখানে রাজনৈতিকতা অনুপস্থিত।যদিও এটা মুলধারা সকল সেক্যুলারের অভিন্ন বাসনা৷ হাল্লাকের কল্যাণে  এই বাসনাকে বুঝতে বেগ পেতে হয় না। যখন তারা ইসলামের বর্গীয়করন ও সংজ্ঞায়ান করে তা হাল্লাক প্রদত্ত রাষ্ট্রের খোদাগিরির কথা ই স্মরণ করিয়ে দেয়। জামান - তৈমুরের লোকায়ত ভাবনা ইসলামের ট্রাডিশন তথা ঐতিহ্য ও অর্থডক্সির যে দীর্ঘ আলাপ ও বয়ানের সিলসিলা বর্তমান তাকে উপেক্ষা, সংকোচন ও খারিজ করে দেয়।এই লোকায়ত ধারার ইসলামের নির্মাণে আগ্রহী হবার অন্যতম কারন এতে ক্ষমতার লড়াই নাই। এই লোকায়ত ইসলাম শুধুই ধর্মীয় বর্গ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয়ে সেক্যুলার রাষ্ট্রের রিকগনিশন দিতে পারে৷ উনাদের এই বিবেচনায় ত্রুটি বিদ্যমান। হুমাইয়ারা ইক্তেদারের বরাত দিয়ে ওসামা আল আযমি দেখাচ্ছেন যে, সেক্যুলারইজম আসবার পূর্বে মুসলিম পরিচয় ছিল রাজনৈতিক৷ সেক্যুলারইজম এসে একে শুধুই ধর্মীয় পরিচয়ের বর্গে সংকোচন ঘটায়। রাজনৈতিক বর্গকে শুধুই ধর্মীয় বর্গ হিসাবে গড়ে তোলার যে নির্মাণ জামান ও তৈমুর প্রস্তাব করে তা ইসলামের রাজনৈতিকতা ও মুসলিম রাজনৈতিক কর্তাসত্তা খারিজের বাসনার প্রকাশ। স্বাধীনতা বা একাত্তর উত্তর বাংলাদেশ রাষ্ট্রে ধর্মের ছেদ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের বুনিয়াদে উগ্র সেক্যুলারবাদের যে পসরা আমরা দেখি তা স্পষ্ট কামালবাদী প্রকল্প। এই কামালবাদী প্রকল্প ইসলামের বুনিয়াদে তৈরি মুসলিম রাজনৈতিকতা, মুসলিম রাজনৈতিক কর্তাসত্তার অপরায়ন, সংকোচন ও খারিজ করে৷ ইসলামি রাজনীতি অপরায়ন, সংকোচন ও খারিজের ফলে সমাজ বি - ইসলামীকরণ হয়৷  মুসলিম রাজনৈতিকতা যা ইসলামের বুনিয়াদে দাঁড়িয়ে তাকে যখন সাংবিধানিক ক্ষমতা বলে নিষিদ্ধ করা হয় তা সুস্পষ্ট কামালবাদ। এছাড়া একাত্তর উত্তর বাংলাদেশে পশ্চিমা - কলিকাতা মিশ্রিত যে সাংস্কৃতিক  পাটাতন ছিল তা পূর্ব বাংলার মুসলিমদের তমুদ্দুন - তহযিবের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। এই সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল নিদিষ্ট শ্রেনীর যারা শহুরে মধ্যবিত্ত  বাঙালি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির ধারক বাহক হিসাবে পরিচিত। জামান ও তৈমুর বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বুনিয়াদি কামালবাদী প্রকল্পের চরিত্র শনাক্তকরণে ব্যর্থ হয়েছে৷ এই ব্যর্থতা আরও স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে ৭৫ এর পট পরিবর্তনের মাধ্যমে যে নয়া রাজনৈতিক পরিমন্ডল তৈরি হয় তার বোঝাপড়ায়৷ ৭৫ উত্তর ক্ষমতার মসনদে শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আগমনকে জামান সমস্যাজনক মনে করে। জিয়ার রাজনীতি, সংবিধান পরির্তনকে জামান বলতেছেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ইসলামিকরণ। মুক্তিযুদ্ধের মোড়কের জায়গায় ইসলামের মোড়কে বেশি প্রাধান্য দেওয়াতেও জামানের গোৎসা স্পষ্ট। জিয়ার রাজনীতি, ৭২ এর কামালবাদী সংবিধান পরিবর্তন, বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও আওয়ামী লীগের প্রত্যাবর্তন মুলধারার সেক্যুলার ডিস্কোর্সের বাইরে বুঝবার তাগিদ সচারাচর দেখা যায় না৷ রাজনীতি তাত্ত্বিক ও বিশ্লেষক তরিকুল হুদা দেখান যে  শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের অন্যতম প্রধান অবদান জাতীয় মীমাংসা তথা ন্যাশনাল রিকন্সিলিয়েশন। হুদা বলেন জাতীয় মীমাংসা তথা ন্যাশনাল রিন্সিলিয়েশনের প্রকাশ ই হলো বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। হুদা স্মরণ করিয়ে দেয় যে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ যতটা না জাতীয়তাবাদ তার চেয়ে অধিক রাষ্ট্রবাদ বা রিপাবলিকানইজম বা ভুখন্ডবাদ৷ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বুনিয়াদি কামালবাদ যা মুজিবনগর সরকারের ঘোষণা পত্রের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করেছিল তাতে মুসলিম, ইসলাম ও ইসলামপন্থার যে অপরায়ন ঘটে তা সুরাহা করতে জিয়া বহুদলীয় গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু করেন। হুদা দেখাচ্ছেন ভারতীয় আধিপত্যবাদ মোকাবিলায় ৭১ এর  পরাজিত অংশকেও কিভাবে রাষ্ট্রের অগ্রগতিতে অংশীদার হবার সুযোগ তৈরি করে দেন। জিয়া যে অংশীদারত্বের রাজনীতির শুরুয়াত  করেছিলেন  তা ৪৭ এর সুরে ৭১ কে বেঁধে ফেলার এক উদাহরণ বৈকি। হুদা স্পষ্ট করে বলেন যে ৭২ এর কামালবাদী সংবিধানের জায়গায় জিয়া বাংলাদেশের মানুষের চৈতন্যে, ইমানকে গুরুত্ব দিয়ে ইসলামি রাষ্ট্র নয় বরং ইসলাম ও মুসলিম বান্ধব আধুনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে অগ্রসর হোন যা বাঙালি জাতীয়তাবাদী সেক্যুলার ডিস্কোর্সের খরিদদার মহাজনদের জন্য অসহ্যকর হয়ে দাঁড়াবে তা বলাই বাহুল্য। জিয়া যে একাত্তরের বিরোধী জামাতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম,  মুসলিম লীগ , চীনা কমিউনিস্ট সহ আওয়ামী লীগের রাজনীতির পথকে সুগম করলো ও সংবিধানের অভিভাবক হিসাবে আল্লাহর উপর পূর্ন বিশ্বাস স্থাপন করলো তা জামানের কাছে ইসলামিকরন! জামান এটা খেয়াল করে নাই যে জিয়ার বা বিএনপির ইসলামি রাষ্ট্র নিয়ে কোন মুগ্ধতা ছিল না৷ মুগ্ধতা না থাকবার পরেও কেন জিয়া ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে সুযোগ দিল?  কারন জিয়া চেয়েছিলেন বাংলাদেশ রাষ্ট্র যে কামালবাদী বুনিয়াদে দাঁড়িয়ে যা দেশের বিরাট অংশকে অপরায়ন করে রেখেছে তা হতে মুক্ত করার মাধ্যমে রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের অগ্রগতি নিশ্চিত করা৷ এই অগ্রগতি নিশ্চিত করবার প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে ঔপনিবেশিক বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্থলে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে পথচলা৷ এই বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের উপর ভিত্তি করেই জাতীয় মীমাংসার প্রস্তাব যার মধ্য দিয়ে ইসলামি রাজনৈতিকতাকে প্রতিপক্ষ হিসাবে নয় বরং পরিপূরক হিসাবে নিয়েছিল।জিয়ার শাসন আমল নিয়ে এটা শুধুই জামান ও তৈমুর একক বোঝাপড়া নয়৷ জামান ও তৈমুরের বোঝাপড়ার প্রকাশ ত শুধুই উপসর্গ৷ এই রোগের গোড়া বাঙালি জাতীয়তাবাদী সেক্যুলার ডিস্কোর্সে৷এই রোগের সুলুকসন্ধান করতে গিয়ে মাইলস্টোন জার্নাল প্রকাশিত শিহান বিন ওমরের " অপরায়নের রাজনীতি : বাঙালি সেক্যুলার জাতীয়তাবাদীদের ডিস্কোর্সে ইসলামপন্থা " প্রবন্ধ সামনে চলে আসে৷ শিহান দেখাচ্ছেন মুসলিম লীগের অপরায়ন করবার রোগ ঐতিহাসিক - রাজনৈতিক সিলসিলার সূত্রে আওয়ামী লীগ ও বাঙালি সেক্যুলার জাতীয়তাবাদীরা ধারন করে। মতাদর্শিক শূন্যতা পূর্ণ করার নিমিত্তে ৭১ এ যেমন অবাঙালিদের অপর হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করেছিল, তদ্রূপ একাত্তর উত্তর বাংলাদেশে ইসলামপন্থাকেও অপর সাব্যস্ত করে। ইসলামপন্থাকে যে শুধুই বাঙালি সেক্যুলার জাতীয়তাবাদীরা অপর করে বিষয় টা এমন নয়। কথিত মার্ক্সবাদীরাও এই পথের মুসাফির ৷ মার্ক্সবাদীদের ইসলাম ও ইসলামপন্থার পর্যালোচনাও ইসলামপন্থাকে অপর হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করে৷ মার্ক্সবাদীদের চোখে ইসলাম প্রশ্ন ও ইসলামপন্থা নিয়ে তরিকুল হুদা তার " এড হমিনেম অথবা সামির আমিনের চোখে ইসলামপন্থা " প্রবন্ধে তাদের স্ববিরোধীতা বেশ সফল ভাবে দেখিয়েছে।একইসাথে দেখিয়েছেন যে  মিশরীয় - ফরাসি মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক সামির আমিন ইউরোপকেন্দ্রিকতা নিয়ে বেশ সরব হয়েও কিভাবে  ইসলাম ও ইসলামপন্থা বিষয়ক মামলায় ইউরোপীয় প্রজেক্টেই সামিল৷ ধান ভানতে শীবের গীত গাওয়া তথা বাঙালি জাতীয়তাবাদী সেক্যুলার ডিস্কোর্সের আলোচনাকালীন মিশরীয় মার্ক্সবাদী তাত্ত্বিক সামির আমিনের কাছে যাওয়ার কারন হলো এটা স্পষ্ট করা যে,  মুসলিমের রাজনৈতিক কর্তাসত্তা স্কীকার না করা,  ইসলাম ও ইসলামপন্থার প্রশ্নে খারিজি রাজনীতি শুধুই আঞ্চলিক নয়, একইসাথে বৈশ্বিক।  মুসলিমের রাজনৈতিক কর্তাসত্তা, বি- ইসলামিকরন ও ইসলামপন্থা খারিজের হিংস্র বাসনা এতোই প্রকট যে প্রগতিশীল সেক্যুলাররা বি- রাজনীতিকরন করে ফ্যাসিবাদী ও স্বৈরশাসককেও অবধি বৈধতা দেয়।উক্ত সেক্যুলার সম্প্রদায় গণতান্ত্রিক পরিবেশ বাজেয়াপ্ত করার প্রস্তাব করে। গণতন্ত্র বাজেয়াপ্ত করবার প্রস্তাবের বাস্তবায়নের দেখা মেলে  শাহবাগ পরবর্তী ঈসায়ী ১৪ এর নির্বাচন হতে মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুডের দমন পীড়নের চিত্রে৷ সেক্যুলার - লিবারেল বা মার্ক্সবাদীর কারনে গণতন্ত্রের শ্মশানযাত্রার সুলুকসন্ধান করেছেন আরেক মিশরীয় তাত্ত্বিক শাদি হামিদ৷ মোহাম্মদ ইশরাক তার " Inventing Islam(ism) : De- Islamization under secular Authoritarianism in Bangladesh " আর্টিকেল শাদি হামিদের বরাত দিয়ে দেখান কিভাবে মুসলিম ভুখন্ডগুলোতে সেক্যুলার - লিবারেলরা গণতন্ত্র বাজেয়াপ্ত করার মাধ্যমে খারিজি রাজনীতি করে। ইশরাক মিশরীয় সেক্যুলার - লিবারেল হতে বাংলাদেশী লিবারেল সেক্যুলারদের একক চরিত্র শনাক্ত করে।ইশরাক নানা তথ্য - উপাত্ত হাজির করে দেখায় কিভাবে বাংলাদেশী সেক্যুলার সম্প্রদায় জামাত ঠেকাও নীতিতে গণতন্ত্র বিলুপ্তকরণে সামিল৷ইশরাক তার লেখায় ফড়িং ক্যামেলিয়া ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের কারিগর দিদারুল ইসলামের কর্মকান্ড তুলে ধরেন।

 "আমার বিরোধী দল যখন জামাত তখন আমি ভোটের অধিকার চাই না।" [ফড়িং ক্যামেলিয়া ]

বি- রাজনীতিকরণের পথে যে শুধুই আঞ্চলিক লিবারেল - সেক্যুলাররা একা মুসাফির বিষয়টা এমন নয়, বৈশ্বিক লিবারেল - সেক্যুলাররা একই কাফেলায় শরিক। বাংলাদেশে এই বৈশ্বিক চিত্র হাজির হয় আলি রিয়াজের আমেরিকান কংগ্রেসের বক্তৃতায় যেখানে আলি রিয়াজ বলেন আমেরিকাকে অবশ্যই বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে ভারতীয় সার্থ হেফাজত করতে হবে৷ শাহবাগের তাত্ত্বিক, বয়াতি

এই মহাজনেরা শাহবাগে যে খারিজি রাজনীতি শুরু করেছিল, তার ফলাফল বাংলাদেশের গণতন্ত্র দিল্লি কা লাড্ডুতে পরিণত হয়!

বি- রাজনীতিকরণ (De- politicization)  করা তথা রাজনীতিকে নাই করে ফেলবার যে প্রস্তাব শাহবাগ আন্দোলন দিয়েছিল তা ছিল বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কামালবাদী (kemalism) সুরতের প্রকাশ। মার্ক্স  বলেছিলেন ইতিহাসে একটা ঘটনা দুইবার ঘটে। প্রথমবার হয় ট্রাজেডি, আর শেষ বার হয় কমেডি তথা প্রহসন। শাহবাগে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের কামালবাদী  রুপের প্রকাশ হয়তো সেই প্রহসনেরই অন্তর্ভুক্ত। প্রহসনের অন্তর্ভুক্ত বলেই হয়তো শাপলার আন্দোলন নিয়ে মার্ক্স, এঙ্গেলস ও বলশেভিকদের পথের বিপরীতে যাত্রা। নাগরিক অধিকারের ইজারাদাররা সরকারের করা নগ্ন এক্সট্রা জুডিশিয়াল কিলিং ও গনহত্যার পরেও আনন্দ উল্লাসে মেতে ওঠে!কেন এই ভাঁড়ামি? তার উত্তর পাওয়া যায় শাহবাগের বাসনায় যা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বুনিয়াদি রোগ তা হলো অপরায়ন তথা খারিজি রাজনীতি। শাহবাগের তাত্ত্বিক, বয়াতি এই মহাজনেরা এত কিছু দেখেও যে দেখতে পেল না, তা কানার হাটবাজার ছাড়া আর কিছু নয়।

 

 

দোহাই

১. ভদ্র, গৌতম। ঈমান ও নিশান। উনিশ শতকের বাংলার কৃষক চৈতন্যের এক অধ্যায় (১৮০০-১৮৫০) সুর্বণরেখা পাবলিশার্স, ১৯৯৩, কলকাতা৷

২. শাহাদুজ্জামান। শাহবাগ ২০১৩। আগামী প্রকাশনী, ২০১৩, বাংলা বাজার ঢাকা।

৩. হুদা, তরিকুল। এড হমিনেম অথবা সামির আমিনের চোখে ইসলামপন্থা; জগলুল আসাদ সম্পাদিত চিন্তাযান, প্রথম বর্ষ, ২য় সংখ্যা, ২০১৯, মুন্সিগঞ্জ

৪. বিন ওমর, শিহান। অপরায়নের রাজনীতি: বাঙালি জাতীয়তাবাদী সেক্যুলার ডিস্কোর্সে ইসলামপন্থা, তানজিন রাশেদ দোহা সম্পাদিত Milestones: Commentary on the Islamic World; Shapla 10 Years Anniversary, 2023. Link

৫. হুদা, তরিকুল। জাতীয় মীমাংসা পর্ব, ইতিহাসযান প্রকাশিত, ২৭ ডিসেম্বর, ২০২২।, Link

৬. Marx, Karl. Early Writings, Translated by Rodney Livingston and Gregor Benton, Penguin Books in Association with new Left Review.

৭. Sayyid, Salman, B. A Fundamental Fear: Eurocentrism and the emergence of Islamism. Zed Books Ltd, London, 1997.

৮. Ishrak Fahim, MD Ashraf Aziz. "Inventing Islam(ism): De- Islamization under Secular Authoritarianism in Bangladesh", Reorient,Vol. 7, No. 2 (Winter 2022).

৯. Nigam, Aditya. "Fascism,The Revolt of The 'Little Man' and Life After Capitalism."Kafila. Online. Link

১০ Crouch, Dave, “The Bolsheviks and Islam”, International Socialism, A quarterly review of socialist theory.