আমাকে যদি মরতেই হয়

Preface

জর্মান দর্শনগুরু মার্টিন হেইদগর তাঁর “বিয়িং এন্ড টাইমে” অস্তিত্ত্বের অন্বেষনে ছড়িয়ে দিয়েছেন মরনের এই ভাবের আলোপ। উনি দেখালেন নিস্প্রান লাশের হাজিরা কিভাবে জিন্দা মরদদেরও ঠেলে দেয় অস্তিত্বের অতলান্তে। লাশ যখন জীবিত ছিল, জ্যান্ত তরতাজা ছিল তখন একেবারে প্রথমে সে মহাকাশে কোন ব্ল্যাকহোলে জন্মায় নাই, মায়ের গর্ভেই ফুলের মতোন ফুটতে থাকে। এরপরে সেই গর্ভ ছেদ করেই তাকে ছুঁতে হয় মাটি, নিতে হয় মাটির স্বোদা গন্ধ। যেই মানব সত্ত্বাকে (Da-sein) ছুঁড়ে দেয়া হয়েছিলো, তার আশেপাশে আরো অনেক অস্তিত্ত্বময় সত্ত্বা এবং বস্তু ও জিনিসপত্র। আবার এই জগতে তার আবির্ভাব শর্তহীন অসীম অনিত্য নয়। বরং জগত জীবনের অন্য সব কিছুর মতোই নিত্য, সীমাবদ্ধ, কিন্তু সম্পর্কিত। আপন এই সত্ত্বা আবার নিজের চাইতে এগুয়ান। সে এখনো যা না, যা কিছু এখনো তার জীবনে হয়ে উঠে নাই, সেই ভবিষ্যতের সম্ভাবনাকেও সে তাড়নায় কামনায় বাস্তব রুপ লাভের আগেই অনুমান করে, কল্পনা করে। করতে করতে সে অস্থির হয়, অথবা আপ্লুত হয়। ভীত বা সন্ত্রস্ত হওয়াও বিচিত্র নয়। এখনো বাস্তবে নাই, কিন্তু সম্ভাবনায় আছে- এমন অনেক কিছুর ভিতরে কোন কোন সম্ভাবনা মূর্ত হয়ে উঠে ভবিষ্যত জীবনে, আর কিছু অধরাই থেকে যায়। অধরা থাকলেও অস্তিত্ত্বের স্বধর্মই হলো প্রতিনিয়ত সম্ভাবনার নৈরাজ্যময় ভবিষ্যতে নিজেকে প্রক্ষেপ করা। তারপরেও এত সম্ভাবনা বা অসম্ভাবনা, পাওয়া না পাওয়ার হিসাব মিলানো সহজ হত, যদি জীবনটাকে শুরু থেকে শেষ অবদি একটা গোটা আস্ত বেদানার মতো আমরা হাতের নাগালে পেতাম। অথচ শেষ বিন্দুতে তার ঠিক আগেই জীবনের মতো মরনও হাজির। তবে তো মৃত্যুও শেষ হিসাবে জীবনের সকল সম্ভাবনা ও না-সম্ভাবনার মোহনা, পরিনত বিন্দু। এখন যেহেতু নিজের মৃত্যুর স্বাদ গ্রহনের পরে ঢেকুর তোলা সম্ভব না, সেহেতু অপরের মরন দর্শনের অভিজ্ঞতাই হয়তোবা দিতে পারে অর্থময় ইঙ্গিত। কিন্তু সেই মরন তো অপরের, নিজের না। আবার অন্যান বস্তু বা জিনিসের মতো না মানুষের অস্তিত্ব। কোন ফুল বা ফল যেমন পরিপূর্নতা পাওয়ার পরেই মরে পচে যায়, মানুষের মৃত্যু তো তেমন না। মানুষ অবশ্যই মরনের ভিতর দিয়ে শেষ হয়, কিন্তু সকল মানুষ তো আর মরনের ভিতর দিয়ে আপন জীবনের পরিপূর্নতা নাও পেতে পারে। সেই সময়ে তার জীবনের সম্ভাবনাগুলি বাস্তব রুপ নাও লাভ করতে পারে। অস্তিত্বময় মানুষের মৃত্যু ভাব তাই না অন্যান্য জীব বা প্রানহীন বস্তুর মতো, না নিছক সামাজিক অপর বা অন্য কোন মানুষের মৃত্যুর মতো, যার জীবন শুধু অস্তিত্ত্বময়তার প্রশ্নহীন প্রানী বা বস্তুর মতো। অস্তিত্বময় মানুষ হিসাবে নিজের মৃত্যু নিয়ে তবে আমরা হয়তো শুধু এইটুকুই বলতে পারি যে, জীবনের যাত্রা হলো মৃত্যুর পথে যাত্রা। মৃত্যুর স্বাদের বর্ননা বা বয়ান তৈরি যেহেতু অসম্ভব, সেহেতু জন্মানোর পরেই ক্রমাগত মৃত্যুর দিকে ঝুঁকে পড়া জীবনই তার উপজীব্য। জীবনের কথা তাই মৃত্যুরই প্রস্তুতি।        

০৭ ই অক্টোবর, আল আকসা তুফানের পর উপনিবেশি - দখলদার রাষ্ট্র ইসরাইল গাযায় যে গনহত্যা চালাচ্ছে, সেই গনহত্যায় শহিদ হয়েছেন গাযা উপত্যকায় জন্ম নেওয়া লেখক, কবি, আক্টিভিস্ট ও গাযা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রিফাত আল আরির৷ রিফাত আল আরির ৬ ডিসেম্বর শহিদ হোন৷ উপনিবেশি - দখলদার রাষ্ট্রের লাশতন্ত্র কায়েম, ফিলিস্তিনি মুক্তিকামী মানুষের উপর লাশতান্ত্রিক ক্ষমতার চর্চা, গ্লোবাল ওয়ার অন টেরর এর স্থানীয় রুপের বিরুদ্ধে রিফাত আল আরির তার লেখনী ও তৎপরতা জারি রেখেছিলেন৷ তার বিখ্যাত কবিতা "If I Must Die " এর বাংলা তর্জমা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সিদ্দিকে আকবর। রিফাত আল আরির কবিতার তর্জমার ভিতর দিয়ে ইসরাইলের সাথে দেশজ লাশ লাশতন্ত্র, লাশতান্ত্রিক ক্ষমতার চর্চার যে বুনিয়াদি - বাসনাগত মিতালি বা সম্পর্ক বিদ্যমান তা সহজেই শনাক্ত করা যায় বৈকি।  তর্জমার মধ্য দিয়ে প্রতিরোধ - সংগ্রামের রুহানি সম্পর্ক অটুট থাকায়, তা আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতায় জীবন্ত রুপে হাজিরা দিতে দেয়। রিফাত আল আরির কবিতা, সিদ্দিকে আকবরের তর্জমার মধ্য দিয়ে ইসরাইল ও বাংলাদেশ রাষ্ট্র এর লাশ রাজনীতির সম্পর্ক বিচার করবার মওকা হয়ে যায়। একাকার হয়ে যায় শাহবাগ, তেল আবিবের লাশতন্ত্র কায়েম বাসনা। অপরদিকে লাশ হয়ে গাযায় ফুটে শাপলা।

Tareq-ul Huda & Abdur Rahman Bari

16 May, 2024

Refaat Alareer

Translation : Siddike Akbar

 

আমাকে যদি মরতেই হয়

তোমার অবশ্যই বাঁচতে হবে।

আমার গল্প বলার জন্যে, আমার জিনিস সওদার জন্যে।

তারপর তুমি এক টুকরা কাপড় কিনবে, আর কিছু দড়ি (সাদা রঙের ঘুড়ি বানাবে,  সাথে থাকবে একটি লম্বা লেজ)

গাজার কোন এক কোনে একটি শিশু, যার চোখ আকাশে নিবদ্ধ, বেহেশতের পানে, বাবার অপেক্ষায়, যে বাবা তাকে ছেড়ে গেছে এক বিস্ফোরণে।

অথচ তার শেষ বিদায় হয়নি,

তার দেহ, এমনকি গায়ের এক টুকরো মাংসও মেলেনি জানাজা দিতে।

সেই ছোট্ট শিশুটি যাতে দেখতে পায় তোমার সাদা ঘুড়ি।

ক্ষণিকের জন্য হলেও শিশুটি যাতে ভাবতে পারে, আকাশ থেকে এক ফেরেশতা তার জন্য ভালবাসার পয়গাম নিয়ে হাজির।

 

আমাকে যদি মরতেই হয়

তা যেন হয় আশার আলো

যেন হয়ে উঠে এক উপাখ্যান।