শাহবাগের বাঁশিওয়ালা
By Tahmid Bhuiyan
বাল্টার বেনিয়ামিন তার বিখ্যাত " The Work of Art in the Age of Mechanical Reproduction " প্রবন্ধে শিল্পের জন্য শিল্প মতবাদ ( Art for Art Sake) কে ধর্মতত্ত্বীয় প্রকল্প (Theological) বলে অভিহিত করেন৷ ফ্যাসিবাদী জর্মন বা ইতালীয় বাস্তবতায় শিল্পের নয়া ফর্ম বা ধরণ সংক্রান্ত আলাপে
বেনিয়ামিনের নয়া সংযোজন হলো গণ - মানুষের অংশগ্রহণ তথা শিল্প ভোগের গণতান্ত্রিক স্তরে রুপান্তর। বেনিয়ামিন গণতান্ত্রিক স্তরে রুপান্তরের সবচেয়ে কার্যকরী মাধ্যম হিসাবে সিনেমাকে শনাক্ত করে৷ হঠাৎ জর্মন-ইহুদি চিন্তক বেনিয়ামিনে আসবার শানে নূযুল শাহবাগ আন্দোলনে শিল্প-শিল্পী-নন্দনতত্ত্ব ও সাংস্কৃতিক বর্গসমূহ নিয়ে পুনঃরায় চিন্তা করতে৷ বাল্টার বেনিয়ামিন প্রযুক্তির উৎকর্ষের দিক বিবেচনায় নিয়ে পুরানো শিল্প মাধ্যমের ধর্মতত্ত্বীয় মহিমার( Aura) খর্বকরণ করে, নয়া শিল্প মাধ্যমে গন-মানুষের হাজিরা, উৎপাদন ও ভোগের সাপেক্ষে অংশগ্রহনমুলকতার প্রস্তাব করে, যা সাংস্কৃতিক রাজনীতির প্রেক্ষিত চিন্তা-উদ্দীপক ই বটে। বেনিয়ামিন যদি শাহবাগ আন্দোলন অবধি হায়াত পেতেন, তাহলে বেনিয়ামিন খেয়াল করতেন যে ইউরোপীয় ফ্যাসিবাদে যেরুপ শিল্পের জন্য শিল্প মতবাদী ধারার প্রতিভা- সৃজনশীলতা মিশে একাকার হয়ে যেতে পেরেছিল ; ঠিক একই ভাবে "বাংলা " মুলকের শিল্প - শিল্পী - প্রতিভা - সৃজনশীলতা ইত্যাদি ইত্যাদি একই তরিকায় ফ্যাসিবাদী শাহবাগে বিলীন হয়ে গেল৷ বেনিয়ামিনের কল্যাণে অগ্রীম বরাত হাতে থাকবার কারনে শহুরে মধ্যবিত্ত বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী কথিত গণ - আন্দোলন শাহবাগে বাংলাদেশ ত বটেই, পশ্চিম বাংলার শিল্পীদের অংশগ্রহন খুব একটা বিচলিত করে না৷ বেনিয়ামিন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, এটা হবার ই কথা ছিল৷
নব্বইয়ের দশকে হুমায়ুন আহমেদের নাটকের বাকের ভাইয়ের ফাঁসি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হিসাবে বিবেচিত হতে পারে৷ বাকের ভাইয়ের ফাঁসি যাতে না হয়, তা নিয়ে শহুরে মধ্যবিত্তের প্রবনতা - ভাষা বা অভিব্যক্তির দিকে নজর বুলিয়ে ; সেই শহুরে মধ্যবিত্ত যখন শাহবাগে ফাঁসির দাবি নিয়ে হাজির হয় তার তুলনা করলে শাহবাগের ফ্যাসিবাদী প্রবণতার শনাক্তি পেতে খুব একটা বেগ পেতে হয় না। এই শনাক্তি হতে স্পষ্ট যে শহুরে মধ্যবিত্ত সমাজে বাকের ভাইয়ের ফাঁসি মেনে নেওয়া যতটা অমানবিক, ঠিক ততোটাই মানবিক হিসাবে বিবেচিত গোলাম আযম বা কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবি করা। অর্থাৎ শহুরে উচ্চ বা মধ্যবিত্ত সমাজের যে উদারনীতিবাদ বা প্রগতিশীলতার মুখোশ তা গোলাম আযম বা কাদের মোল্লার বেলায় খুলে যায়। উনিশ শতকে জন স্টুয়ার্ট মিল এই কলোনিয়াল উদারনীতি ভারতীয় সমাজের জন্য প্রস্তাব করেন। পার্থ চ্যাটার্জি দেখাচ্ছেন, কিভাবে কলকাতার মিশ্র সিভিল সোহাইটির সাথে ইংরেজ উদারনীতি উসুলি ও তরিকাগত ভাবে আলাদা হয়ে গেল। পার্থ চ্যাটার্জির উছিলায় শহুরে উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্ত সমাজে উদারনীতি সংক্রান্ত মোনাফেকি নিয়ে নোকতা দিয়ে যেতে পারি। তাহলে,গণ আদালত হতে শাহবাগের কথিত গণ - জাগরণ অবধি শহুরে উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্তের ফাঁসির বাসনাকে শুধু উদারনীতিবাদের মোনাফেকি বা কন্ট্রাডিকশন হিসাবেই দেখব? বিষয় টা কি এমন যে, নসিহার দরুণ এই মোনাফেকি হতে ইমানদার সহি লিবারেল হইলে, এই ফাঁসির বাসনা হইত না। নাকি অন্য কোন কিছু যা চোখে দেখা যাচ্ছে না?
ফরাসি ঐতিহাসিক আর্নেস্ট রেঁনো জাতিরাষ্ট্রের উদয়কালে সহিংসার প্রসঙ্গ হাজির করেন তার বিখ্যাত "জাতি কি " রচনায়। রেঁনো দেখান উদয়কালে সেই রক্তাক্ত হিংস্রতা - বর্বরতা মানুষ ভুলে যায়। অপরদিকে বেনেডিক্ট এন্ডারসন বলেন, কই ভুলে যায়? ভুলে যাওয়ার মিছে অভিনয় ত মনে করবার ই প্রচেষ্টা! ভুলে যাওয়া বা হঠাৎ মনে হওয়ার সাপেক্ষে এখানে প্রাসঙ্গিক আকারে হাজির হয় শত্রু চিহ্নিতকরণ ও তার নির্মূল করার সহিংস বাসনা। পুরো জাতি এই কাল্পনিক শত্রুের বিনাশের জন্য নিয়োজিত হয়। ক্যামেরুনীয় তাত্ত্বিক আশিলি এম্বেম্বে দেখান, কাল্পনিক শত্রুের শরীরলে লাশতান্ত্রিক ক্ষমতা (Nacropower) কায়েম করবার মাধ্যমে তার নির্মূল বা বিনাশের যে বাসনা ছিল তা পূর্ণ করে। এইভাবে শুরু হয় লাশ রাজনীতির শুরুয়াত। কাল্পনিক শত্রুর শরীলকে লাশ বানাতে একে একে জড়ো হয়৷ খুন করবার এই শিকল প্রক্রিয়া চলতে থাকে। এই শিকল প্রক্রিয়ায় কাল্পনিক শত্রু হিসাবে ভ্রুন শিশু অবধি হাজির থাকে। একাত্তর - উত্তর বাংলাদেশে কাল্পনিক শত্রুের নির্মান, তার নির্মূলের বাসনায় শরীলকে লাশ বানানোর যে রাজনীতি তার চূড়ান্ত সমবেত স্থান হলো শাহবাগ। শাহবাগ হঠাৎ করে গজিয়ে উঠা কোন আন্দোলন নয়৷ শাহবাগ এক ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ। এই সন্ধিক্ষণে কল্পিত শত্রুের খুনের মাধ্যমে লাশ রাজনীতির যে ঐতিহাসিক যাত্রা তার চুড়ান্ত রুপ দেখা যায়।
কল্পিত শত্রুকে খুন করতে খুনিদের ভ্রাতৃত্ব তৈরি হয়৷ ভ্রাতৃত্ব এর উপর ভিত্তি করে নির্মূলের জন্য খুনি চক্র তৈরি হয়। খুনি চক্রকে উজ্জীবিত করতে থাকে গায়ক, বাঁশিওয়ালা, নট - নটী। শাহবাগের খুনি চক্রকে উজ্জীবিত করতে অনেক গায়ক, বাঁশিওয়ালা হাজির ছিল। তন্মধ্যে পশ্চিম বাংলার গায়ক কবির সুমন, গণিত অলিম্পিয়াডের চমক হাসান, জিয়া হাসান, প্রতুল মুখোপাধ্যায়, পিলু ভট্টাচার্য, শিবু শীল সহ অনেক ব্রান্ড দল শাহবাগের বাঁশিওয়ালা রুপে হাজির হয়। বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলার শিল্পীরা শাহবাগের খুনের - জাগরণ মঞ্চে নিয়ে আসেন। শিল্প - প্রতিভা - সৃজনশীলতা ইত্যাদি ইত্যাদি শাহবাগের ফ্যাসিবাদী - লাশ রাজনীতির খুনি চক্রের উজ্জীবিত করতে শিল্পের নিয়োগ করে। বেনিয়ামিন এই তার জর্মন বাস্তবতায় এই দিকটি বুঝতে সক্ষম হয়েছিল৷ বেনিয়ামিনের ভাষা ধার করে বললে শাহবাগে সেই ফ্যাসিবাদের পুনঃউৎপাদন৷
মেয়র ও এলাকাবাসী হ্যামিলিয়নের বাঁশিওয়ালার কৃতজ্ঞতা স্বীকার না করলেও, শাহবাগ কিন্তু শাহবাগের বাঁশিওয়ালার কৃতজ্ঞতা করছে৷ শাহবাগের বাঁশিওয়ালা হিসাবে আর্বিভূত হয়েছিলেন পশ্চিম বাংলার গায়ক কবির সুমন। গন জাগরণ মঞ্চের পক্ষ থেকে কবির সুমনের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা হয়৷ কবির সুমন পশ্চিম বাংলা ও বাংলাদেশে মশহুর গায়ক। কবির সুমন শাহবাগের প্রতি সংহতি জানিয়ে তার গণ দাবি আলব্যাম বের করেন৷ প্রথমেই কবির সুমনের সাক্ষাৎকার হতে সুমনের চিন্তার কাচ্চা দিক গুলো বের করে নেওয়া যাক৷ সুমন শাহবাগে তরুন প্রজন্মের এই খুন চক্রের মবকে বলছেন গণতন্ত্রকামী।
সুমনের বর্ণনায় :
" একটি আন্দোলনকে কিভাবে এ রকম গণতান্ত্রিক ও সর্বজনীন করা যায়, সেটি বাংলাদেশের এই প্রজন্ম দেখিয়ে দিলেন। আমি তাঁদের স্যালুট জানাই। "
সুমনের "গণতান্ত্রিক" "সর্বজনীন" শব্দদ্বয় ব্যবহার কতটুকু সচেতন ব্যবহার ছিল তা শাহবাগের প্রতিরোধ সরুপ যখন শাপলা হাজির হলো তখন ই প্রমানিত হয়৷ সর্বজনীন, গণ, গণতান্ত্রিক ইত্যাদি ইত্যাদি শব্দের ব্যবহার করা শাহবাগ আইনের বাইরে গিয়ে ফাঁসি চেয়ে নিল? আইন কে বুড়ো আংগুল দেখিয়ে ফাঁসি চাওয়া গণতান্ত্রিক হবার নমুনা? শহরে মধ্যবিত্ত তরুণ প্রজন্ম যে কল্পিত শত্রুের খুনের মঞ্চ তৈরি করছে, তাতে সুমন আরও ফুঁ দিয়ে আগুন দিলেন তার গানের মাধ্যমে। সুমনের মানবতাবাদী গান " আমি চাই " তে সে বলতেছেন " আমি চাই ধর্ম বলতে মানুষ বুঝবে মানুষ শুধু "। মানবতাবাদী এই সুমন শাহবাগের খুন মঞ্চে খুনি চক্রকে উজ্জীবিত করল, তার গান দিয়ে ; সেখানে যার বা যাদের লাশ ফেলা হচ্ছে সে কি তাহলে সুমনের কাছে মানুষ না? যদি মানুষ হত, তাহলে আইনকে বুড়ো আংগুল দেখিয়ে যে খুন মঞ্চের আয়োজন, তাতে তার মানবতাবাদ কিভাবে একাকার হল? সুমন প্রতিবাদী হিসাবে পরিচিত৷ সুমনের ভারতের বাস্তবতায় ক্ষমতাকে প্রশ্ন করবার তার নজির আছে। "আমি চাই " গানে সুমন গাইছেন " আমি চাই কাশ্মীরে আর শুনবে না কেউ গুলির শব্দ "। সুমন কাশ্মীরে গুলির শব্দ শুনতে পায়। সেই গুলির শব্দ আর সে শুনতে চায় না৷ তার চাওয়া গুলির শব্দ বন্ধ হোক। কিন্তু শাহবাগে যখন পুলিশি পাহাড়ায় আন্দোলন হচ্ছে, আর ইসলামপন্থীদের উপর পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছে, তখন সুমনের ক্ষমতাকে প্রশ্ন করার ইতিহাসের ছেদ ঘটল কেন? যে সুমন পাহাড়ে সাঁওতালের উপর গুলি চালানো বুঝে, সে কেন ঢাকায় সাইদির রায়ের পর গুলি চালানো বা শাপলা চত্তরের গনহত্যা বুঝে না?
সুমন দাবি করে দক্ষিণ এশিয়ায় কখনো গণতন্ত্র ছিল না৷ শাহবাগ আন্দোলন দেখে সুমনের মনে হয়েছে, শাহবাগের মাধ্যমে গণতন্ত্র আসছে৷ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা বলতে সুমন কি বুঝে তা পরিস্কার করেন নাই৷ সুমনের বর্ণনায় :
"বিশ্বের আর কোথায় গণতন্ত্র আছে না আছে, সেটা আমার আগ্রহ নেই। কিন্তু উপমহাদেশে গণতন্ত্র ছিল না। এই আন্দোলন দেখে আমার মনে হয়, উপমহাদেশে গণতন্ত্র আসছে। নবীনরাই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবে। "
সুমনের বর্ণনায় গণতন্ত্র পীরিতি দেখে মিশরীয় মার্ক্সবাদী সামির আমিনের কথা স্মরণ হল। ইসলামপন্থী রাজনৈতিক সংগঠন ইখওয়ানুল মুসলিমীনকে যখন সেনা ক্যু করে ক্ষমতা হতে সড়িয়ে, লাশতান্ত্রিক রাজনীতির ফলে রাবা স্কয়ার লাশের পাহাড় হয়ে গেল ; তখন সামির আমিন কবির সুমনের মতোই বলেছিল, মিশরীয় সিপাহি - জনতার বিপ্লব বা এর মাধ্যমে নয়া গণতান্ত্রিক সংযোজন দেখবে আগামীর মিশর। সামির আমিন ইসায়ী ২০১৯ সাল অবধি জীবিত ছিলেন৷ আব্দুল ফাত্তাহ আল সিসির গণতান্ত্রিক মিশর আর দেখে যেতে পারে নাই। সুমন এই দিক বিবেচনায় সামির আমিনের চেয়ে খুশ-নসিব বলা যায়। জীবনের ৭৫ তম বসন্তে পা দিলেন ; সাথে বাংলাদেশের গণ মানুষকে উপহার দিলেন ফ্যাসিবাদী লুটেরা - মাফিয়া রেজিম৷ সুমনের বাঁশির সুরে উজ্জীবিত হয়ে শাহবাগ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পথচলাকে উল্টে দিল, সুমন কি তা বুঝেন?
শাদি হামিদ দেখান মিশরীয় লিবারেল - মার্কসবাদীরা কিভাবে মিশরের গণতন্ত্র এর গোরস্তান বানিয়ে ফেলছে। ঠিক একই কায়দায় সুমনের প্রানের শাহবাগ বাংলাদেশের গণতন্ত্র এর শ্মশানযাত্রায় অগ্রণী ভুমিকা পালন করেছে৷ ইসলামপন্থার রাজনৈতিকতা ঠেকাতে ফ্যাসিবাদী ক্ষমতার মসনদকে বৈধতা দিয়েছে৷ মোহাম্মদ আশরাফ আজিজ ইশরাক ফাহিম তার "Inventing Islam(ism): De- Islamization under Secular Authoritarianism in Bangladesh " আর্টিকেলে দেখান, শাহবাগ আন্দোলন ও দেশীয় সেক্যুলার - প্রগতিশীল সমাজ জামাত ঠেকাও নীতিতে
গণতন্ত্র এর শ্মশানযাত্রায় শরিক। ইশরাক, রাজনীতি বিজ্ঞানের অধ্যাপক আলি রিয়াজ সহ সেক্যুলার গবেষক ও এক্টিভিস্টদের বয়ান পেশ করেন৷ আলি রিয়াজ মার্কিন কংগ্রেসে বক্তৃতায় প্রস্তাব করেন যে শাহবাগ - উত্তর বাংলাদেশে ১৪ এর নির্বাচনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই ভারতীয় স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে নীতি ঠিক করতে হবে৷ আক্টিভিস্টরা প্রচার করে ইসলামের রাজনৈতিকতা ও তার ক্ষমতায়ন ঠেকাতে তারা গণতন্ত্র কুরবানি করতে রাজি আছেন৷ সুমন যেহেতু শাহবাগের তরুন প্রজন্ম নিয়ে খুব আশাবাদী, তাই ফড়িং ক্যামেলিয়াকে ই উপযুক্ত মনে করলাম উদাহরণ হিসাবে। গণতন্ত্র নিয়ে শাহবাগের তরুণী ফড়িং ক্যামেলিয়া কহেন : "আমার বিরোধী দল যখন জামাত তখন আমি ভোটের অধিকার চাই না।" তাহলে দেখা যাচ্ছে, সুমনের বর্ণনায় উপমহাদেশের প্রথম গণতন্ত্রকামী শাহবাগ গণতন্ত্র কে কবর দিয়ে দিচ্ছে, নির্মূলের বাসনায়।
সুমন নন্দীগ্রাম নিয়ে গান আলব্যাম করেছে৷ পশ্চিম বাংলার রাজনীতির প্রেক্ষাপটে নন্দীগ্রাম আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ৷ পশ্চিম বাংলায় ৩৪ বছরের বাম আমলের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেওয়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি, নন্দীগ্রামের আন্দোলনের পরে যদি গণতন্ত্র, নির্বাচন বাদ দিয়ে মাফিয়া - লুটেরা - লাশতান্ত্রিক - ফ্যাসিবাদী শাসন প্রতিষ্ঠা করত, তাহলে কি সুমন তখনো তার প্রাথমিক মুগ্ধতা - সংহতি জারি রাখত? পশ্চিম বাংলাতে যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আছে, তা নিয়ে আমার আলাপ না। কিন্তু বাংলাদেশের সাপেক্ষে তুলনা করলে আমরা দেখি সেখানে বি-রাজনীতিকরণ ঘটে নাই৷ কারন কবির সুমনেরা আগে ঘর, পরে পর নীতিতে যথেষ্ট আমলদার৷ সুমন ফোলানির লাশ নিয়ে গান গেয়েছে। ফেলানি হত্যার বিচার চেয়েছে৷ তার অধিকারের পক্ষে কথা বলছে৷ এগুলো বাংলাদেশের প্রগতিশীল সেক্যুলার মহলে বেশ সমাদৃত। কিন্তু এই সুমন ই শাহবাগে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ - আধিপত্যবাদ নিয়ে প্রশ্ন করতে পারলেন না। ৭১ এ চারু মজুমদার, অসীম চট্রোপাধ্যায় সহ নকশালপন্থীরা ভারতীয় সম্প্রসারণবাদী নীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। কই! সুমন ত শাহবাগের সাথে ভারতীয় আধিপত্যবাদী সম্পর্কের বিচার করতে পারলেন না। সুমনের এই নাকামিয়াবি বুঝতে আমাদের সাহায্য করে ওরিয়েন্টালিজম ধারণা।
এডওয়ার্দ সাঈদ তার ওরিয়েন্টালিজমে দেখান পশ্চিম প্রাচ্যকে অসভ্য কল্পনা করে, প্রাচ্যে সভ্যতা - চেরাগের আলো পাঠাতে হাজির হয়। অসভ্য কে সভ্য করে তুলবার এই সভ্যতার দায়িত্ব পশ্চিম নিজের কাঁধে নেয়। ওরিয়েন্টালিজম তথা প্রাচ্যবাদ ছিল উপনিবেশবাদের প্রসূতি। ওরিয়েন্টালিজমকে আরও পুনঃর্পাঠ করেন ওয়ায়েল হাল্লাক৷ হাল্লাক এখানে সাইদের প্রাচ্যবাদ বোঝাপড়ার সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করন ও পর্যালোচনা হাজির করার ভিতর দিয়ে ওরিয়েন্টালিজম পাঠকে আরও শক্তিশালী করেন৷ হাল্লাক দেখান, সাইদের পাঠ মুলত আইসবার্গ স্তরে।
হাল্লাক এর জ্ঞানতত্ত্ব - কাঠামোকে প্রশ্নবিদ্ধ করে যা সাঈদ করতে পারেন নাই। সম্প্রতি হাল্লাককে ব্যবহার করে ইরফান আহমেদ আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন হিন্দু ওরিয়েন্টালিজম। দিল্লি বা কলকাতার প্রাচ্য রুপে হাজির হয় বাংলাদেশ। ডান - বাম - মধ্যম সকলকে মিলিয়েই ভারতীয় প্রকল্পে বাংলাদেশ হাজির হয়। কবির সুমন মানবিক দিক বিবেচনায় নিয়ে ফেলানির বিচার চাইতে গান ফেদে বসলেও, তিনি দিনশেষে ওরিয়েন্টালিস্ট চোখ দিয়ে বাংলাদেশ, শাহবাগ আন্দোলন, এদেশের রাজনৈতিক হাল হাকিকতকে দেখছেন। বৃহৎ ভারতীয় প্রকল্পের বাইরে কবির সুমন বের হতে পারেন নাই। বিশেষত শাহবাগ আন্দোলন তার ই জীবন্ত উদাহরণ। বাঙালি জাতীয়তাবাদী নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত কবির সুমন মনে মনে বাংলাদেশের নাগরিক হলেও, আদতে সে যে ভারতীয় আধিপত্যবাদী নীতির ই মৌন সমর্থক তা বলতে খুব বেগ পেতে হয় না।
এবার, কবির সুমনের শাহবাগ আন্দোলনের গানে নজর দেওয়া যাক। সুমনের গান শাহবাগের থিম সং মর্যাদায় আসীন হয়। "গণ দাবি " "শাহবাগে রাতভর " গান দুটোতেই পয়লা দেখা যাক।
'শাহবাগে রাতভোর
স্মৃতিতে একাত্তর
নব ইতিহাসে সাক্ষী রইল
প্রজন্ম চত্বর।
স্লোগানে স্লোগানে কাঁপে
লাখো নবীনের বুক
ছেলেমেয়েদের মুখেই
আমার বাংলাদেশের মুখ "
সুমন শাহবাগের সাথে একাত্তরের সম্পর্ক শনাক্তি করতে সক্ষম হয়েছে বৈকি। শাহবাগ ত সিম্পটম। শাহবাগের ফাঁসির দাবির একাত্তরীয় ভারসন ছিল "একটা একটা মাওড়া ( অবাঙালি) ধর, ধইরা ধইরা জবাই কর "। একই টেরিটরিতে থেকে অবাঙালি বিহারি মুসলিম জেনোফোবিয়ার শিকার হয়। একই টেরিটরিতে থাকা ইসলামপন্থীদের ফাঁসি চাওয়া হয়, উলামায়ে কেরামের উপর গনহত্যা করা হয়। অথচ, ভিন্ন টেরিটরির সুমন কিভাবে বাংলাদেশের হয়? প্রতিবেশিদের খুন করে, গনহত্যা করে, উচ্ছেদ করে এই জাতীয়তাবাদী প্রকল্প জায়নবাদের ফিলিস্তিনিদের উপর করা উচ্ছেদ, গনহত্যা, খুন, বর্ণবাদের কথা মনে করিয়ে দেয়।এর মধ্যে দিয়ে সুমন দিনশেষে নিজকে হিংস্র বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিলীন করলেন। সুমন সাক্ষাৎকারে জানাচ্ছে তার আশা বাংলাদেশের নাগরিক হবার। নাগরিক তার সহ নাগরিকের প্রতি এরুপ হবেন? সুমন শাহবাগকে বানিয়ে দিলেন বাংলাদেশের মুখ। সুমন যদি ভারতের মুখ বলে দিত, তাহলে আপত্তি ছিল না। শাহবাগকে বাংলাদেশের মুখ বলবার ভিতর দিয়ে সুমন যে সর্বজনীনবাদের ফ্যান্টাসি থেকে মুক্ত নয় তা প্রমান করলেন৷
"হাত ধরে ছেলেমেয়ে
মুক্তির গান গেয়ে
জেগে আছে আজ প্রহরীর মতো
আসল বিচার চেয়ে।
শহীদ জননী দেখছেন
জাগরণ প্রস্তুতি
সুফিয়া কামাল কাছেই আছেন
বিদ্রোহী নাতিপুতি।"
শাহবাগে রাতভর গানে সুমন যে আত্মবিরোধে আছেন, সুমন তাও বে-মালুম হয়ে যাচ্ছেন৷ আদালতের বিচারকে উপেক্ষা করে, " আসল বিচার "
বলবার ভিতর দিয়ে সুমন মূলত শাহবাগের খুন করবার বাসনার মাত্রা বাড়িয়ে দিলেন৷ শহীদ জননী, জাগরণ প্রস্তুতি দেখছেন বলবার ভিতর দিয়ে, শাহবাগের খুন মঞ্চের ঠিকুজি গণ আদালতের দিকে ইশারা করেন। গণ দাবি গানে সুমন বলেন " যার যা পাওনা তাকে সেটা দাও, গণ দাবি একটাই। " যার যা পাওনা আর গণ দাবির মাঝে ফারাক আছে। গণ দাবি ফ্যাসিবাদী হতে পারে। গণ দাবি যদি মানতে হয় তাহলে আর যার যা পাওনা তাকে সেটা দেওয়া হবে কিভাবে?
"বাঁচো গণদাবি, বাঁচো গণদাবি
আসল বিচার চাই,
যার যা পাওনা তাকে সেটা দাও
গণদাবি একটাই। "
সুমন "যার যা পাওনা তাকে সেটা দেওয়া " এবং " গণ দাবি " বলবার ভিতর দিয়ে আত্মবিরোধী হয়ে উঠেন৷ একাত্তরে পাকিস্তানি আর্মির হাতে যেমন গনহত্যা হয়েছে, যুদ্ধাপরাধ হয়েছে তদ্রূপ মুক্তিফৌজের হাতেও অবাঙালি বিহারি মুসলিম, পাহাড়ি, প্রো পাকিস্তানি সিভিলিয়ান, চীনা কমিউনিস্ট গনহত্যা, ধর্ষণ, সম্পদ লুন্ঠনের শিকার হয়। একাত্তরের পরে তাদের রেলওয়ে থেকে, দেশীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ভিটেমাটি দখল করে নেয় মুক্তিফৌজ। সুমন যদি আসল বিচার বা যার যা পাওনা তাকে সেটা দেওয়া চাইত, তাহলে ক্যাঙারু কোর্টের বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ করত! ন্যায় বিচারের জন্য প্রস্তাব করত বা রিকন্সিলিয়েশনের প্রস্তাব করত। সুমন দীর্ঘদিন মার্কিন মুলুকে থেকেছেন। সাদারা ঠিক একই উপায়ে কালোদের এরকম ক্যাঙারু কোর্টে বিচার করত, তা সুমনের নজরে আসেনি। দক্ষিণ আফ্রিকা,রুয়ান্ডায় রিকন্সিলিয়েশন হয়েছে। সুমনের মানতাবাদী গালগল্প নাই হয়ে গিয়ে হিংস্র খুনি চক্রের সাথে মিতালি গড়ে উঠে। প্রণব মুখার্জি হতে কবির সুমন দের সাথে শাহবাগের এই মিতালির মর্ম ইসলামের রাজনৈতিকতা নির্মূল, তার ক্ষমতায়নে বাধা৷ এর জন্য যদি বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ কায়েম করতে হয়, তারজন্য তারা সবটুকু দিবেন। কিন্তু ইসলামপন্থা নির্মূল করে ছাড়বেন। গণতান্ত্রিক গালগল্প করা এই দাদাবাবুরা অ- গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম করতেও পিছপা হোন না। সুমনের ৭৫ তম জন্মদিনে তিনি বাংলাদেশের গণ মানুষকে দিয়েছেন ফ্যাসিবাদ, লুটেরা, মাফিয়া, লাশতান্ত্রিক, অ- গণতান্ত্রিক শাহবাগ ; যার বাসনা ভারতীয় আধিপত্যবাদী প্রকল্পের খাতিরে ইসলামের রাজনৈতিকতা নির্মূল ও রাজনীতির বিলোপ সাধন। শাহবাগের দানের এই বাংলাদেশে গুম হয়ে যাওয়া বাবার জন্য অপেক্ষায় থাকা শিশুর বদদোয়া - ঘৃণার একটু অংশ কবির সুমন কি দাবি করতে পারেন না?
হদিস
1.Benjamin, Walter. The Work of Art in the Age of Technological Reproducibility and other Writings on Media edited by Michael W jennings, Brigid Doherty and Tomas Y Levin, Harvard University press.
2.Mbembe, Achille, Necropolitics, translated Steven Corcoran, Duke University press, 2019
3.https://www.milestonesjournal.net/shapla-10-year-anniversary-1/2024/1/15/-
4.https://www.jstor.org/stable/48706617
5.https://sumanami.co.uk/%e0%a6%97%e0%a6%a3%e0%a6%a6%e0%a6%be%e0%a6%ac%e0%a6%bf/
6.https://sumanami.co.uk/%e0%a6%b6%e0%a6%be%e0%a6%b9%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%97%e0%a7%87-%e0%a6%b0%e0%a6%be%e0%a6%a4%e0%a6%ad%e0%a7%8b%e0%a6%b0/
7.https://sumanami.co.uk/%e0%a6%b6%e0%a6%be%e0%a6%b9%e0%a6%ac%e0%a6%be%e0%a6%97%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%a4%e0%a6%b0%e0%a7%81%e0%a6%a3%e0%a6%a6%e0%a7%87%e0%a6%b0-%e0%a6%b8%e0%a7%8d%e0%a6%af%e0%a6%be%e0%a6%b2%e0%a7%81%e0%a6%9f/
8.চ্যাটার্জি, পার্থ। জনপ্রতিনিধি, অনুস্টুপ