Milestones

View Original

নসিহার রাজনীতি

By Abdur Rahman Bari


قُلِ اللّٰهُمَّ مٰلِکَ الۡمُلۡکِ تُؤۡتِی الۡمُلۡکَ مَنۡ تَشَآءُ وَ تَنۡزِعُ الۡمُلۡکَ مِمَّنۡ تَشَآءُ ۫ وَ تُعِزُّ مَنۡ تَشَآءُ وَ تُذِلُّ مَنۡ تَشَآءُ ؕ بِیَدِکَ الۡخَیۡرُ ؕ اِنَّکَ عَلٰی کُلِّ شَیۡءٍ قَدِیۡرٌ

کُنۡتُمۡ خَیۡرَ اُمَّۃٍ اُخۡرِجَتۡ لِلنَّاسِ تَاۡمُرُوۡنَ بِالۡمَعۡرُوۡفِ وَ تَنۡهَوۡنَ عَنِ الۡمُنۡکَرِ وَ تُؤۡمِنُوۡنَ بِاللّٰهِ ؕ وَ لَوۡ اٰمَنَ اَهۡلُ الۡکِتٰبِ لَکَانَ خَیۡرًا لَّهُمۡ ؕ مِنۡهُمُ الۡمُؤۡمِنُوۡنَ وَ اَکۡثَرُهُمُ الۡفٰسِقُوۡنَ

 মহাত্মা লাঁকা ফরমান "ইতিহাস অতীত নয় "। লাঁকা সাহেবের মতে, বর্তমানের আলোয় অতীতকে দেখা ই ইতিহাস। ভূতে ফিরে ইতিহাস বদলানো যায় না। উল্টো বর্তমান বদলায় বলে ইতিহাস বদলায়। মানুষ ভূতে ফিরে ভবিষ্যতে যেতে চায় ভূত পুনঃউৎপাদনের জন্য নয়৷ ভূতে ফিরে ভবিষ্যতে তাকানোর চেষ্টা পর্দাবৃত ইতিহাসের মুখের দিকে নজর দেওয়া। আধিপত্যবাদী চলতি ভাবাদর্শিক বয়ান যে ক্ষমতাকেন্দ্র তৈরি করে, তা পর্দাবৃত ইতিহাসের মুখ দেখে ভয়ে চুপসে যায়। হয়ত ইতিহাসের এই মুখ ইমানুয়েল লেভিনার অপর মুখের ন্যায়, যা বিনাশর্তে নৈতিকতার আহবান ছড়ায়। পর্দাবৃত ইতিহাসের মুখ দেখে যায় যায় কি চেনা? নাকি মুখের আড়ালে পড়শি লুকায় ইতিহাসের অব্যক্ত যন্ত্রণা ? পড়শির মুখ ই মুখোশ। পড়শির বাসনার জগৎ ও তার " অপর " কে বুঝতে ইতিহাসের অলিগলি স্মরণ করার ক্ষমতায় আপাতত আস্থা রাখ যাক। ফ্রয়েডের উছিলায় বলা যায় স্মরণ করবার ক্ষমতার নিয়ামক হলো অজ্ঞান।

ঈসায়ী ১৯০৮, অমৃতসরে মুসলিম লীগের অধিবেশনে  সভাপতির বক্তৃতায় সৈয়দ আলি ইমাম সর্বভারতীয় মুসলিম ইতিহাস স্মরণ করে আওরঙ্গজেবকে সর্বভারতীয় মুসলিম প্রতীক হিসাবে খারিজ করেন। মুসলিম লীগের মতোন একই অবস্থান নেন আল্লামা ইকবাল। তিনি আওরঙ্গজেবের শাসনকে তরিকা হিসাবে কঠোর ও তা হিতে বিপরীত হবার সম্ভবনা উস্কে দেয় বলে সুশীল মুরুব্বীদের মতোন শঙ্কা প্রকাশ করেন৷ আওরঙ্গজেবকে মুসলিম প্রতীক হিসাবে নাকচ করেন ভারতীয় জাতীয়তাবাদী মওলানা আবুল কালাম আজাদ। সৈয়দ আলি ইমাম বা আল্লামা ইকবালের চেয়েও কঠোর শব্দে আজাদ আওরঙ্গজেবের সমালোচনা করেন৷ সুফি সারমাদ শাহিদকে নিয়ে লেখা' রুবাইয়াৎ - ই সারমাদে' আজাদ বলেন, আওরঙ্গজেব ইসলামের অপব্যবহার করেছে। তার মতে, সারমাদের রক্ত আওরঙ্গজেবকে মৃত্যুর আগ অবধি তার নিন্দ বাজেয়াপ্ত করেছিল। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ আওরঙ্গজেব কে নিজেদের প্রতীক হিসাবে ব্যবহার করেনি। অথচ পাকিস্তান আন্দোলনে আওরঙ্গজেব হাজিরা দেয় অজ্ঞান হয়ে।

ঈসায়ী ১৯৪৬, পাঞ্জাব হইতে বাংলা, পাকিস্তান কা মতলব কেয়া ; লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ স্লোগানে মুখরিত । পাকিস্তান রাষ্ট্র নির্মাণের তাগিদে প্রাদেশিক নির্বাচনী জঙ, ওয়াদা, মুজাহাদা, কোরবানি, পায়তারা, ফয়সালার সেই ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে পাঞ্জাবের লাহোরে জমিয়ত ই ওলামায়ে ইসলামের অধিবেশনে সভাপতির বক্তৃতায় মওলানা শাব্বির আহমদ উসমানি, মুজাদ্দিদে আলফে সানি আহমদ সিরহিন্দকে স্মরণ করেন। শাব্বির আহমদ উসমানি বলেন, আহমদ সিরহিন্দ হচ্ছেন সেই ব্যক্তি, যিনি প্রথম আকবরের "মুত্তাহিদা কওমিয়াত" তথাকথিত দ্বীনি এলাহির বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক সংগ্রাম শুরু করেন৷ শাব্বির আহমদ উসমানি দ্বীনি এলাহির নয়া সুরুত হিসাবে গান্ধীবাদকে শনাক্ত করে, আহমদ সিরহিন্দির ঐতিহাসিক সংগ্রামের সিলসিলা জারি রাখবার প্রস্তাব দেয়৷ উক্ত সংগ্রামে শরিকানার আরজি জানায়।

ঈসায়ী ১৯৪৬, আরেক মশহুর মওলানা ও রাজনীতিবিদ আবুল কালাম আজাদ পাঞ্জাবের উর্দূ সাময়িক পত্র চাতানে পাকিস্তান আন্দোলন নিয়ে সাক্ষাৎকার দেওয়া কালীন, সম্পাদক শসির কাশ্মীরি কহেন, পাকিস্তান আন্দোলনের সনে ওলামা সমাজের একাংশ একাত্মতা ঘোষণা করেছে। অথচ আপনারা দাবি করেন, পাকিস্তান আন্দোলন ইসলাম এবং ওলামা বিচ্ছিন্ন! দাবির পক্ষে যুক্তি সমেত জবাবে মওলানা আজাদ বলেন, বাদশাহ আকবরের সময়ে, তার আশেপাশে ওলামা সমাজের এমন একাংশ   ছিলেন, যারা তার জন্য নতুন ধর্ম আবিষ্কার করেছিলেন ; কিন্তু আজ মুজাদ্দিদে আলফে সানি আহমদ সিরহিন্দ ছাড়া বাকি কাউকে মানুষ সম্মান প্রদর্শন করে না৷ পাঞ্জাব - বিহার ছাড়িয়ে আহমদ সিরহিন্দ বাংলায় এসে যায়৷ বাংলায় শর্ষিনার পীর সাহেব মওলানা নেসারুদ্দীন আহমদ জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের ৩য় অধিবেশনে ফরমান, পাকিস্তানের বুনিয়াদ খাজা আহমদ সিরহিন্দের সঙ্গে সম্পর্কিত৷

পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষে - বিপক্ষে উভয় ধারা মুজাদ্দিদে আলফে সানি আহমদ সিরহিন্দের সিলসিলা দাবি নিছক কাকতালীয় ঘটনা? নাকি পাকিস্তান আন্দোলন সংক্রান্ত যাবতীয় বয়ান- প্রতি বয়ানের সমান্তরালে অবদমিত দশা! এমন এক  ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে উভয় পক্ষ  মুজাদ্দিদে আলফে সানি আহমদ সিরহিন্দের সিলসিলায় সামিল হবার কোশেশকে রাজনৈতিক ধর্মতত্ত্বের উছিলায় (Political Theology) বাছ-বিচার উক্ত নিবন্ধের অনুপ্রেরণার উৎস৷ বাংলাদেশের বিদ্যায়তন বা বিদ্যায়তনের বাইরে যে বারোয়ারি আধিপত্যবাদী জ্ঞানতত্ত্ব-ছক-ভাষা-রাজনৈতিকতা জাহের আছে, তাতে পাকিস্তান আন্দোলনকে প্রধানত দুই পদ্ধতিতে দেখা যায়৷  মার্ক্সীয়-উদারনীতিবাদী ইতিহাস ব্যবসায়ী মহাজনদের পহেলা ধারার কাছে পাকিস্তান আন্দোলন সাম্প্রদায়িকতা, মুসলিম জাতিবাদ, মুসলিম-জায়ন, নাড়িকাটার বিচ্ছেদ ; ধ্রুপদী মার্ক্সীয় তরিকায় দুসরা ধারার কাছে পাকিস্তান আন্দোলন হাজির হয় শুধুই জমিদার বনাম প্রজার লড়াই-সংগ্রাম-বিজয় বা সাংস্কৃতিক আজাদি রুপে। মার্ক্সীয় - উদারনীতিবাদী ইতিহাস ব্যবসায় পাকিস্তান আন্দোলনের অবয়ব বা সুরুত দেখতে যতটা আগ্রহী , ঠিক তার মর্মের সন্ধান করবার চেষ্টা শুন্যের কোটায়।

পাকিস্তান আন্দোলনের মর্মের তলব করে, তার কুলুজি - রাজনীতি - বাসনার নোকতা হাজির করে, পাকিস্তান আন্দোলনে ওলামা বর্গের মেহনত-মুজাহাদা- চিন্তা - তৎপরতা -বিরোধীতা ও রাজনৈতিকতার উৎসের পর্যালোচনা করে ; পাকিস্তান আন্দোলন-উত্তর রাষ্ট্র গঠন, ঐতিহ্য, নসিহার রাজনীতির স্থলে আধুনিক রাষ্ট্রের দিক বিবেচনায় ঐতিহ্যবাহী ইসলামপন্থার রুপান্তর -  বিকাশ ও নয়া ক্ষমতার অংশীদারিত্বের ইতিহাসের অর্থবেদ উক্ত নিবন্ধের বাসনা। পাকিস্তান আন্দোলনকে উছিলা করে নসিহার রাজনীতি ও তার রুপান্তরের ফলে ঐতিহ্যবাহী ইসলামপন্থার যাত্রার সুলুকসন্ধান করব যাতে; আজকের রাজনৈতিক বর্তমানে দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক ভবিষ্যতে মোলাকাত - সংলাপ- মোকাবিলা করবার মওকা মেলে। প্রাক-আধুনিক যামানার নসিহার রাজনীতির নকল বা অক্ষরবাদী পাঠের যে বাজারি বয়ানের বিকার প্রকাশ পায়,  তার কার্যকারণ হদিস করব। মুঘল সালতানাত হতে পাকিস্তান আন্দোলন অবধি বন্ধুত্ব ধারণা ও উক্ত ধারণার সাপেক্ষে আন্তঃমুসলিম বাহাসের মূলনীতি তলব করে, তার সঙ্গে পাকিস্তান আন্দোলনের যোগসূত্র নির্ণয় করব।

১.(ক) আয়েশা জালাল দেখান পাকিস্তান রাষ্ট্র আকস্মিক ফলাফল। তার মতে, জিন্নাহ ঘুনে ধরা সার্বভৌম আলাদা পাকিস্তান চাননি৷ ব্রিটিশ কেবিনেট মিশনের প্রস্তাবে জিন্নাহ নিম রাজি ছিলেন, কিন্তু কংগ্রেস নেতৃত্ত্ব তা কবুল করেনি৷ অনিতা ইন্দার সিং আয়েশা জালালের প্রস্তাবকে পর্যালোচনায় নিয়ে দেখান ৪৭ এর পাকিস্তান, মুসলিম লীগের লাহোর প্রস্তাবে ব্যক্ত করা যুক্তির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। মার্কসবাদী হামজা আলভি দেখান পাকিস্তানের উদ্দেশ্য ছিল  "সেক্যুলার" - কোন ধর্মীয় নয়। হারুন-উর - রশিদ বাংলায় জিন্নার সাথে মুসলিম লীগের ভিন্নতা চিহ্নিত করে দেখান, তাদের স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান বা সার্বভৌম অখন্ড বাংলা বাসনা৷ জয়া চ্যাটার্জি বাঙালি মধ্যবিত্ত হিন্দু ভদ্রলোক ও জনতত্ত্ব দিয়ে দেশভাগ /আজাদি বুঝবার কোশেশ করেন৷

দীপেশ চক্রবর্তী জয়া চ্যাটার্জির এই প্রস্তাব সমর্থন করলেও, তিনি জয়া চ্যাটার্জির প্রস্তাবে বাঙালি হিন্দুর "ভয় " কে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা না করবার দিকটি শনাক্ত করেন৷ দীপেশ চক্রবর্তীর বয়ানে বাঙালি হিন্দুর "ভয়" সুলুকসন্ধান করা না হলে, তথ্যগত দিক দিয়ে দেশভাগ বুঝা যাবে না। ফয়সাল দেভজি পাকিস্তান ও ইসরাইল রাষ্ট্র গঠনের ভাষা - মাত্রা - বয়ান -  যুক্তি ও আন্তর্জাতিক  তৎপরতাকে সামনে হাজির করে প্রস্তাব করেন মুসলিম জায়ন। মুসলিম জাতীয়তাবাদী ও ইহুদি জাতীয়তাবাদী ধারাকে গুরুত্ব দিয়ে দেভজির প্রস্তাব। বাঙালি মুসলিম ভাবুকদের পূর্ব পাকিস্তান রুপায়ন ও সাংস্কৃতিক আজাদি বাসনা চিহ্নিত করেন নীলেস বোস৷ মার্ক্সবাদী ধারার আরেক পাঠে পাকিস্তান আন্দোলন শুধুই জমিদার বনাম প্রজার শ্রেণী সংগ্রাম বা অধিকার আদায়ের এক ধাপ৷ তাদের দাবি, এখানে ধর্মের মোড়কে শ্রেণী সংগ্রাম ঘটেছে৷ দেশভাগ / আজাদীর উপরিক্ত নাট্যমঞ্চে ওলামা সমাজ অনুপস্থিত৷

বারবারা মেটকাফের উছিলায় দেশভাগ / আজাদীর নাট্যমঞ্চে ওলামা সমাজ হাজির হয়।  বারবারা মেটকাফ জমিয়তে ওলামায়ে  হিন্দ ও মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানিকে নিয়ে দেখান, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতীয় ওলামার ভূমিকা ও পাকিস্তান আন্দোলনের ধর্মতত্ত্বীয় বিচ্ছিন্নতা। মেটকাফ হোসাইন আহমদ মাদানির মুত্তাহিদা কওমিয়াতের ইংরেজি তরজমার ভূমিকায় এর "সেক্যুলার " চরিত্র শনাক্ত করেন। ভ্যানকাত ধুলিপালার বরাতে,মেটকাফের প্রস্তাবের পর্যালোচনা হাজির হয়। মাওলানা শাব্বির আহমদ উসমানির নয়া মদিনার তত্ত্বয়ান ও প্রস্তাবনা ধুলিপালা শনাক্ত করেন , যেখানে পাকিস্তান আন্দোলনের ধর্মতত্ত্বীয় দিক স্পষ্ট ভাবে উপস্থিত হয়। মেটকাফ, মুশিরুল হক ও মেগান ইটন রব আশরাফ আলি থানভির সঙ্গে মুসলিম লীগের সম্পর্ক নির্ণয় করেন। কাশিম জামান আশরাফ আলি থানভির ইসলামি ঐতিহ্য কে সামনে রেখে মুসলিম লীগের রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তির বৈধতার কথা উল্লেখ করেন। ধুলিপালা বা মেগান ইটন রব বা কাশিম জামান আশরাফ আলি থানভি ও শাব্বির আহমেদ উসমানির পাকিস্তান আন্দোলন বা মুসলিম লীগ নিয়ে প্রস্তাব ও তৎপরতা শনাক্ত করতে কামিয়াব হলেও, এই প্রস্তাব বা তৎপরতা যে মূলনীতিতে, তার ঐতিহাসিক - রাজনৈতিক - বাসনাগত চরিত্র ও ঠিকুজীর বাছ-বিচার করতে পারেনি।

১.(খ) পাকিস্তান আন্দোলন নিয়ে আশরাফ আলি থানভি ও শাব্বির আহমেদ উসমানির চিন্তা - প্রস্তাব - তৎপরতার মূলনীতির ঐতিহাসিক - রাজনৈতিক বাসনা ও তার কুলুজির হদিস করবার উত্তম মাধ্যম হল মুঘল সালতানাত এবং শাসকের সঙ্গে ওলামা বর্গের সম্পর্ক বিচার। রোমান্টিক ইতিহাস পাঠের মুছিবত হলো, এতে  আগাম অনুমান করা হয় প্রাক আধুনিক "দাওলাহ” শাসকের যাপিত জীবন ধর্মীয় নিয়মের অধীন ছিল। ইতিহাসে দাওলাহ শাসক নিয়ে এমন একদেশদর্শী পাঠ - নানা প্রতিক্রিয়ার জন্ম দেয়৷ একদেশদর্শী ইতিহাস কবুল করে বর্তমানের সহিত ভূতের তুলনা চলে, জন্ম নেয় হতাশা৷ ইতিহাস পাঠের অক্ষরবাদীতা পর্যবসিত হয় ইতিহাসের খারিজি পাঠে৷ কাশিম জামান তার " Religion and Politics under Early Abbasids : The Emergenc of the Proto - Sunni Elite " বইয়ে আব্বাসী জামানায় রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তি  (Political Authority) এবং ধর্মীয় কর্তাব্যক্তি ( Religious Authority) এর সম্পর্ক বিচার করেন৷ রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তির ক্ষমতায় ধর্মীয় কর্তাব্যক্তি হস্তক্ষেপ করত না৷ ধর্মীয় কর্তাব্যক্তি চাইত, ইসলামের তুরাস - শারিয়ায় রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তিরা যেন নাক না গলায়৷ তাদের কাজ ছিল ইসলামের আইনি কাঠামো বহাল রাখা এবং তা অনুযায়ী শারিয়া আদালত পরিচালনা করা। শাসকের ধর্মতত্ত্বীয় বৈধতা দানে তাদের ভূমিকা ছিল৷ আপন আপন পরিসরে  শাসক - ওলামা তাদের কাজ করত। ওলামার একটা অংশ শাসক থেকে দূরত্ব বজায় রাখতেন৷ অপর অংশ সম্পর্ক রাখতেন, তবে তা নসিহার মূলনীতিতে। শাসকের বৈধতা নিয়ে সুন্নি রাজনৈতিক তত্ত্ব ও শিয়া রাজনৈতিক তত্ত্বের কিছু দিকের ভিন্নতা থাকলেও, শুরুর দিকে ইসনে আশারি শিয়া রাজনৈতিক তত্ত্বের বির্তকে অবৈধ শাসক এবং তার শাসনে সহযোগিতার সম্পর্ক বাস্তবতা -অভিজ্ঞতা - শর্তের অধীন সাপেক্ষ অনুমতি দেওয়া হয়।

মধ্যযুগে শাসকদের নৈতিক - ধর্মীয় শিক্ষার জন্য লিখিত হয় "শাহজাদাদের  আয়না " ( Mirror for Princes)। ইমাম আল গাজ্জালি তার " নসিহাত - উল - মুলক ', ইমাম মারওয়ার্দী তার " আল - মালিক ওয়া - সিয়াসাত আল - মুলক ", আল ত্বহা-আলবি তার " আদাব আল মুলক " গ্রন্থে শাসকের চরিত্র, ন্যায় ভিত্তিক শাসন প্রতিষ্ঠা, সার্বভৌমতত্ত্ব, প্রশাসন কাঠামো সহ শাসক ও শাসন প্রক্রিয়ার সাথে সংযুক্ত বিষয় অন্তর্ভুক্ত করেন। শাসক ফাসিক হলেও ধর্মীয় কর্তাব্যক্তিরা ফাসিক শাসকের শাসনকে বৈধতা দিয়েছেন। এই বৈধতার উৎস  ইসলামের এলমি তুরাস। অতএব, ইতিহাসে শাসক ও ওলামা শ্রেণীর সম্পর্ক ক্ষমতার লড়াই নয়, বরং তা অনেকাংশেই নসিহা ভিত্তিক। ওলামা সমাজের পাশাপাশি শাসক বা শাসনের বৈধতা দেওয়া আরেক বর্গ হলো সুফি - দরবেশ। আব্বাসি - উত্তর দুনিয়ায় এদের অধিক প্রভাব  ছিল। সাফাভি - মুঘল সালতানাতকে তার নমুনা হিসেবে নেওয়া যায়। মুঘল শাসকদের সঙ্গে সুফি  রিশতা বেশ পুরানা। বাবর থেকে আকবর বা দারাশিকো থেকে আওরঙ্গজেব সকলের সঙ্গে নানা সুফি তরিকার যোগাযোগ ছিল।

 বাদশাহ আকবর সাফাভি - তৈমুর প্রভাবিত হয়ে নিজকে ইসলামের মুজাদ্দিদ হিসাবে হাজির করে। আজফর মঈন তার " The Millennial  Sovereign : Sacred Kingship & Sainthood in Islam " বইয়ে সাফাভি - মুঘল শাসক বিশেষত শাহ ইসমাঈল ও আকবরের পবিত্র সার্বভৌমত্ত্ব দাবি শনাক্ত করেন৷ মঈন বলেন, " Both Mughals and Safavids embraced a style of sovereignty that was 'saintly ' and ' messianic ' " ইসলামের সহস্রাব্দ বছর পর নতুন যুগের সূচনা করেন আকবর। দ্বীনি এলাহির চালু আকবরের পাগলামি নয়। বরং আকবর নিজকে মুজাদ্দিদে আলফে সানি দাবি করেন। এই সহাস্রব্দের বয়ান ( Millennial Discourse)  আকবর একা দাবি করে নি। সাফাভি শাহ ঈসমাইল হতে মুঘল শাসনে থাকা আরও অনেকে দাবি করেছে। ইতিহাসবিদ সঞ্জয় সুব্রহ্মম্রানিয়াম, ষোড়শ শতকে বৈশ্বিক বয়ানে এর উপস্থিতি নিশ্চিত করেন।  আহমদ সিরহিন্দ আকবরের এই মুজাদ্দিদে আলফে সানি দাবি মানেনি। স্বয়ং তিনি তা দাবি করেন৷  তৈমুর হতে যে পবিত্র রাজত্বের ধারণা সাফাভি - মুঘল সালতানাতে হাজিরা দিয়েছিল, তাকে ইনকার করে আহমদ সিরহিন্দ - আকবরের অবস্থান বুঝা যাবে না৷ আকবরের বিরুদ্ধে আহমদ সিরহিন্দের লড়াই বা জাহাঙ্গীরের আমলে তার কারাবাসের পর আহমদ সিরহিন্দ, তার পরিবারের সঙ্গে মুঘল অন্দরমহলে নসিহার সম্পর্কের ব্যাকরণ বুঝা যায়।

মুঘল শাসকদের সঙ্গে সুফি ধারার সম্পর্কের ধরণ বিচার করেছেন মুজাফফর আলম। মুজাফফর আলম তার " The Mughal and The Sufis : Islam and Political Imagination in India, (1500-1750) " বইয়ে দেখান মুঘল সালতানাতের ক্ষমতাকেন্দ্রকে নিয়ন্ত্রণ করতে চিশতিয়া সুফি সিলসিলা ও নক্সাবন্দিয়া - মুজাদ্দিদিয়া সিলসিলার লড়াই। আলিগড়ের ইতিহাসবিদ ইরফান  হাবিব ও ইয়োহান ফ্রিডমান মুঘল সালতানাতে আহমদ সিরহিন্দের প্রভাব নিয়ে আলাপ করেছেন। কিন্তু এই পাঠের মুছিবত হচ্ছে ব্যক্তির গুনকীর্তন বা মহিমা (Aura) প্রকট। যেহেতু আমাদের সন্ধানের শানে নুযূল মূলনীতি বা ছক, তাই ব্যক্তির চেয়ে বুনিয়াদ - তরিকা অগ্রাধিকার পায়৷ ব্যক্তিকে সময়ের চিহ্ন বা উৎপাদন হিসাবে পাঠ করতে আগ্রহী। মুজাফফর আলম ব্যক্তির প্রভাব - গুনকীর্তন - মহিমার প্রচার করেনি৷ মহিমার অবসান করে, বরং তিনি নানা মাত্রা - চলক - সম্পর্ক - দশা - ভাষা - বাসনা বুঝবার কোশেশ করেছে।

মধ্য এশিয়ায় নক্সাবন্দী ও ভারতের মুজাদ্দিদি তরিকার মতে, রাজা বা সম্ভ্রান্ত পরিবার - প্রশাসনিক ব্যক্তিবর্গের মাধ্যমে শারিয়ার প্রয়োগ ঘটানো যাবে। ফলে তাদের নসিহার কেন্দ্রে থাকত এরা। তবে, এই মত শুধুই মুজাদ্দিদি বা নক্সাবন্দীর নয়। মুঘল যুগে চিশতিয়া সিলসিলার সুফি ধারা অভিন্ন পদ্ধতি অনুসরণ করত । এখানে উল্লেখ করে রাখা ভালো যে, মুজাদ্দিদিয়া তরিকায় শরিয়ত অধিক গুরুত্ব পায়। অপরদিকে চিশতিয়া তরিকা শরিয়তি আইন কাঠামোর স্থলে গণ মানুষ কেন্দ্রিক শামা - কাওয়ালি - উরস - বন্ধুত্ব এর প্রস্তাব করত। উভয় ধারা ক্ষমতা কেন্দ্রের শরিক হয়ে নিজ নিজ তরিকার শান-শৌকত বৃদ্ধি করত৷ মুঘল যুগে চিশতিয়া তরিকার সঙ্গে মুজাদ্দিদি তরিকার শামা- কাওয়ালি - উরস - অমুসলিমের সনে বন্ধুত্ব নিয়ে নানা বাহাস হয়। নক্সাবন্দী - মুজাদ্দিদি সিলসিলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব আহমদ সিরহিন্দের সঙ্গে চিশতিয়া তরিকার আরেক পুরোধা আব্দ-আল রহমান চিশতির বাহাস উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ক্ষমতা কেন্দ্রকে ব্যবহার করে এক পক্ষ মুঘল আদালতে শারিয়া বহাল রাখতে চায়৷ অপর পক্ষ চায়, তাদের যাপিত জীবনে শামা - কাওয়ালী - উরসে যেন বাধা না আসে তা নিশ্চিত করতে।  এখানে দুই পক্ষের দাবির চেয়ে, তাদের দাবির পদ্ধতি অধিক গুরুত্বপূর্ণ৷ রাজার ধর্ম ই প্রজার ধর্ম। রাজা বদলে গেলে প্রজা বদলে যাবে৷ তাই রাজাকে পরামর্শ দিতে হবে, ধর্মে মন দিতে। তাহলে প্রজা অনুকরণ করবে রাজাকে। নসিহার এই প্রাথমিক সূত্র চিশতিয়া হতে মুজাদ্দিদিয়া তরিকা অনুসরণ করেছে৷“ The real purpose is that because of their entrance (dukhul) in the Chishti order, it will acquire an enhanced value in the eyes of people in general, and they will then be attracted to join it. “ মুজাফফর আলমের উছিলায় নিজামের জবানিতে নসিহার প্রাথমিক সূত্রের দিক স্পষ্ট হয়। অপরদিকে আহমদ সিরহিন্দির পরে তার ছেলে শাইখ মাসুম মুঘল অন্দরমহলে প্রবেশ করে৷ চিঠিপত্রের মাধ্যমে শাইখ মাসুম আওরঙ্গজেব সহ মুঘল প্রশাসনিক কাঠামোয় যুক্ত ব্যক্তিবর্গকে নসিহত করেন। শাইখ মাসুমের মাকতুব তথা চিঠিপত্রের সংকলন হতে নসিহার মূলনীতি জানা যায়। “ Our pirs, the Naqshbandi Shaikhs, follow sunnah ( the path of prophet), refrain from bid'a(innovation) , enjoining what is right, and forbidding what is wrong (al-amar bi'l ma'ruf wa'n nahy 'ani'l munkar. " মুঘল হেরেমে শাহজাদীদেরকেও নসিহা দেওয়া হয়। শাহজাদী জাহানারা কাদরি সুফি সিলসিলায় ছিলেন৷ অপরদিকে রওশন আরা মুজাদ্দিদি - নক্সাবন্দী সিলসিলায়। একজন দারাশিকো ভক্ত, অপরজন আওরঙ্গজেবের।

শাইখ মাসুম দারাশিকোর সমালোচক ছিলেন। কারন, দারাশিকোর শারিয়া বহাল রাখবার সম্ভবনা ছিল না। শাইখ মাসুম আওরঙ্গজেবকে  অমুসলিমের সঙ্গে ‘বন্ধুত্ব ‘ ধারণা নিয়ে নসিহত করেন৷ উল্টো দিকে, দারাশিকোর বন্ধুত্ব ধারণা ভিন্ন ছিল। অমুসলিমের সঙ্গে বন্ধুত্ব ধারণা কে কেন্দ্র করে আওরঙ্গজেব - দারাশিকো'র রাজনৈতিক চিন্তা এবং এর সাথে মুজাদ্দিদি - চিশতিয়া তরিকার যোগসূত্র বিদ্যমান। মুজাদ্দিদি তরিকার মুখপাত্র শাইখ মাসুম অমুসলিমের সঙ্গে বন্ধুত্বকে শরিয়তের নিক্তি দিয়ে মাপতেন। অপরদিকে দারাশিকোর বন্ধুত্ব ধারণায় ভারতীয় দর্শন, উপনিষদ এবং লঘু যোগবশিষ্ঠের সঙ্গে চিশতিয়া সুফি তরিকার সমন্বয় ছিল। শাইখ মাসুম চিশতিয়া সুফি তরিকায় অমুসলিমের সঙ্গে বন্ধুত্ব ধারণার সীমাবদ্ধতা তার নসিহত মূলক চিঠিপত্রে উল্লেখ করেন৷ মুঘল যুগে ভারতীয় দর্শন, রামায়ণ - মহাভারত সংস্কৃত হতে ফার্সিতে অনুবাদ হয়৷ আকবরের সভায় নানা ধর্মের পন্ডিত ব্যক্তিত্ব নিজেদের শাস্ত্রীয় বয়ান নিয়ে হাজির হতেন। জাহাঙ্গীরের সময়ে সংস্কৃত হতে অনেক বই ফার্সিতে অনুবাদ হয়, যা অনুবাদ আন্দোলন ( Translation Movement) নামে পরিচিত৷ শংকর নায়ার তার “ Translating Wisdom “ বইয়ে হিন্দু সংস্কৃত পন্ডিত দের সাথে মুসলিম পন্ডিতদের জ্ঞান বিনিময় - অনুবাদের ইতিহাস তুলে ধরেন। মুজাফফর আলম এবং সঞ্জয় সুব্রহ্মম্রানিয়াম জাহাঙ্গীরের রাজসভায় হিন্দু-মুসলিম-খিস্ট্রানের ধর্মতত্ত্ব নিয়ে বাহাস হাজির করেন৷ অনুবাদের মধ্যে লঘু যোগবশিষ্ঠ অন্যতম। দারাশিকোর বন্ধুত্ব ধারণা ও তার দার্শনিক - রাজনৈতিক বাসনার চিত্র পাওয়া যায় লঘু যোগবশিষ্ঠে। দারাশিকোর বাসনার জগত ছিল লঘু যোগবশিষ্ঠের রামচন্দ্রের মতোন, যেখানে রক্তপাত বা সহিংসতা বা শত্রুতা বন্ধুত্বে রুপান্তর ঘটে। দারাশিকোর রাজনৈতিক প্রকল্পের কেন্দ্রে ছিল অহিংস - আধ্যাত্মিক রাম৷ মুজাফফর আলম দারাশিকোর বাসনার জগৎ শনাক্ত করে দেখান দারাশিকো রামকে অনুকরণ যোগ্য হিসাবে পান৷  “Dara Shukoh found a model for the Indian Saint-king, on which presumably he would have gone on to build the moral foundation of his own reign. It is in the dream of Dara where, true to teaching of the Yogavasistha concerning time and narrative, the prince finds himself in the company of a counterfactual genealogy - in which Dara is the younger brother of Rama, hie elder and contemporary. “

২.(ক) কারেন বার্কে, সুদীপ্ত কবিরাজ এবং ভৎশাল নরেশ সম্পাদিত “ Negotiating Democracy and Religious Pluralism “ বইয়ে, ফয়সাল দেভজি তার “ Fatal Love : Intimacy and Interest in Indian Political thought “ নিবন্ধে ভারতীয় রাজনৈতিক তত্ত্বে বন্ধুত্ব - অন্তরঙ্গতা - স্বার্থ ও নিঃস্বার্থের রাজনীতির সুলুকসন্ধান করেন। ফয়সাল দেভজি ভারতীয় রাজনৈতিক তত্ত্বে স্বার্থ ও নিঃস্বার্থের রাজনীতির পঞ্চপাণ্ডব হিসাবে  - আম্বেদকর, সাভারকার, জিন্নাহ, ইকবাল ও গান্ধীকে শনাক্ত করে ; উক্ত পঞ্চ-পান্ডবের রাজনৈতিক বাসনা বুঝতে চেষ্টা করেন। আম্বেদকর ধর্ম-ধর্মীয়তার বাক্সের বাইরে গিয়ে সম্পদ - মালিকানা - স্বার্থ ইত্যাদির সাপেক্ষে মীমাংসার প্রস্তাব করে। তার মতে, হিন্দু-মুসলিমের মানসিক দশা অসম্পূর্ণ। ফলে তারা স্বার্থ বুঝতে নাকামিয়াব। ক্লান্তিকালে, তারা দেশের ভাগ্য নির্ধারণে অরিপক্ক - বিচ্ছিন্ন। আম্বেদকরের এই মূল্যায়নের মর্ম হচ্ছে, ধর্ম-ধর্মীয়তা বিচ্ছিন্নতা তৈরি করে । আম্বেদকর কেবিনেট মিশনের সদস্য এ. ভি আলেক্সান্ডারকে লেখা চিঠিতে উল্লেখ করেন : ‘’ To my mind, it is only right to say that the Hindus and Muslims are today mentally incompetent to decided upon the destiny of this country. Both Hindus and Muslims are just Crowds. It must be within your experience that a crowd is less moved by material profit than by passion collectively shared. It is easier to persuade a mass of men to sacrifice itself collectively than to act upon a cool assessment of advantage. “ দেভজি আম্বেদকরের এই অবস্থান কে অনেকটা উপনিবেশি রাষ্ট্রের তৃতীয় পক্ষের (Third Party) অবস্থানের সঙ্গে তুলনা করেন৷ ভারতীয় হিন্দু সমাজ বর্ণ ভিত্তিক। আম্বেদকর দলিত সমাজের নেতা। আম্বেদকর তার বইয়ে প্রশ্ন করেন কংগ্রেস ও গান্ধী দলিতদের জন্য কি করেছে? “ The isolation and exclusiveness following upon the class structure creates in the privileged classes the anti-social spirit of gang. It feels it has interest ‘ of its own’ which it makes it’s prevailing purpose to protect against everybody even against the interest of the state. “ আম্বেদকর উঁচু বর্ণের রাজনৈতিক মাঠে দলিতদের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে ধর্মীয় বিচ্ছিন্নতা হতে মুক্ত “ দুনিয়াবি স্বার্থ” এর প্রস্তাব করে, যা কংগ্রেসের উঁচু বর্ণের রাজনৈতিক কাঠামোয় ব্রাত্য থাকে।

বিনায়ক দামোদার সাভারকার ও মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ হিন্দু - মুসলিমের অন্তরঙ্গতার কারনে তাদের স্বার্থের রাজনীতির লোকসান দেখতে পান৷ তাদের মতে হিন্দু - মুসলিমের অন্তরঙ্গতা বা অতি পীরিতি সহিংসতার কারন৷ জিন্নাহ এখানে সমাজপত্তন নামা ( Social Contract) করতে প্রস্তাব করে। জিন্নাহ উত্তরাধিকার সংক্রান্ত দুই ভাইয়ের মধ্যে মীমাংসার রুপক ব্যবহার করেন৷ জিন্নার দাবি মতে পিতার সম্পদ দুই ভাইকে শত্রুতে পরিণত করে। আইনি চুক্তির মাধ্যমে মীমাংসা এমন এক তরিকা যা বন্ধুত্বের নতুন শর্ত তৈরি করে। ফলে সহিংসতা এড়িয়ে ভাই বন্ধুতে রুপান্তর হয়।

আম্বেদকর, জিন্নাহ, সাভারকারের স্বার্থের রাজনীতির ( Politics of Interest) স্থলে গান্ধীর প্রস্তাবনা নিঃস্বার্থের রাজনীতির ( Politics of Disinterest)। গান্ধীর মতে ভারতীয় সমাজ পাঠে উপরিক্ত মহাজনেরা নাকামিয়াব৷ এয়ুরোপীয় সমাজের মতোন ভারতীয় সমাজে স্বার্থের অস্তিত্ব নেই। স্বার্থের ভিত্তিতে ভারতীয় সামাজিক সম্পর্ক সক্রিয় না৷ গান্ধীর চিন্তায় স্বার্থ ধরা দেয় অর্থনৈতিক বর্গ হিসেবে যা উপনিবেশ বহাল রেখেছে, ফলে তার দাবি তৃতীয় পক্ষের মাতুব্বরিতে স্বার্থের রাজনীতি ফলপ্রসূ হবে না। ভগভদগীতার নীতির (desireless action) উপর ভিত্তি করে গান্ধী ত্যাগ বা নিঃস্বার্থের রাজনীতি পেশ করেন, যেখানে মহব্বত ও ত্যাগ প্রধান রুপে হাজির থাকে ; যা ভারতীয় সমাজে স্বার্থ বা সামাজিক চুক্তির চেয়ে অধিক ঐক্য এবং স্বাধীনতা নিশ্চিত করে। গান্ধীর বয়ানে : “ The test of friendship is assistance in diversity, and that too, unconditional assistance. Co-operation that needs consideration is a commercial contract and not friendship. Conditional cooperation is like adulterated cement which does not bind. It is the duty of the Hindus, if they see the Justice of the Mahomedan cause, to render co-operation. If the Mahomedans feel themself bound in honour to spare the Hindus feelings and to stop cow-killing, they may do so, no matter whether the Hindus co-operate with them or no. Though, therefore, I Yield to no Hindus in my worship of the cow, i don't want to make the stopping of cow-killing a condition precedent to co-operation.” মুঘল শাহজাদা দারশিকোর মতোন গান্ধীর বন্ধুত্ব ধারণা শর্তহীন। দারাশিকো - গান্ধীর রাজনৈতিক বাসনা অভিন্ন, যেখানে বন্ধুত্ব-মহব্বত কোন শর্তের অধীন নয়। দারাশিকো মুঘলদের সঙ্গে হিন্দুদের বন্ধুত্ব ধারণাকে চুক্তি থেকে বের করে  শর্তহীন মহব্বতে রুপান্তর করতে চেয়েছিলেন৷ গান্ধীর এই রাজনৈতিক তত্ত্ব আলোর মুখ দেখে খিলাফত - অসহযোগ আন্দোলনে৷ গান্ধীর পাশাপাশি জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দ ইসলামের সাপেক্ষে এই বন্ধুত্ব ধারণাকে বৈধতা দেয়। নিঃস্বার্থের রাজনীতি জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দকে প্রভাবিত করে। এটা ছিল নিঃস্বার্থের রাজনীতি সফলতা।

২.(খ) গান্ধীর নিঃস্বার্থের রাজনীতি ( Politics of Disinterest)  জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের কোরবানির রাজনীতির ( Political of Sacrifice) অনুপ্রেরণা, যার চিত্র দেখা যায় খিলাফত-অসহযোগ আন্দোলনে। খিলাফত আন্দোলনের সময় মওলানা আবুল কালাম আজাদ, মওলানা আব্দুল বারি ফারিঙগী মহলি ও জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ অমুসলিমের ( হিন্দু) সঙ্গে বন্ধুত্বের প্রস্তাবনা হাজির করে। প্রস্তাবের মর্ম হচ্ছে,খিলাফতের সার্বভৌমত্ত্ব রক্ষা করতে হিন্দুদের ( কংগ্রেস - গান্ধী) সঙ্গে রাজনৈতিক ঐক্য করতে হবে। শের আলি তারিন তার সম্প্রতি বের হওয়া বই “ Perilous Intimacies : Debating Hindu - Muslim Friendship After Empire “ খিলাফত আন্দোলন কালীন অমুসলিমের সঙ্গে বন্ধুত্ব ধারণা নিয়ে আন্ত:মুসলিম বাহাস বিশ্লেষণ করেন। গান্ধীর নিঃস্বার্থের রাজনীতি ও জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের ত্যাগের রাজনীতির সমান্তারালে সার্বভৌমত্ত্বের রাজনীতির দেখা মেলে। শের আলি তারিন মওলানা আবুল কালাম আজাদ - মওলানা আব্দুল বারি ফারিঙগী মহলির সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী বেরেলভি মওলানা আহমেদ রেযা খানের বাহাস সামনে আনেন। এই বাহাসে দুই পক্ষের বন্ধুত্ব ধারণার সঙ্গে পাকিস্তান আন্দোলনের রিশতা প্রকট। উল্লেখ্য যে দেওবন্দী মওলানা আশরাফ আলি থানভি গান্ধীকে তাগুত বলে খিলাফত আন্দোলনের বিরোধিতা করেন৷ আধিপত্যবাদী বাজারি বয়ানে রেযা খান - থানভির এই বিরোধিতাকে ঔপনিবেশিক শক্তির সহায়ক হিসাবে বুঝা হয় - যা ইতিহাসের অক্ষরবাদী পাঠ বৈকি। শের আলি তারিন দেখান মওলানা আবুল কালাম আজাদ এবং মওলানা আহমদ রেযা খান উভয়ই কুরআনের সুরা মুমতাহিনার ৮-৯ আয়াত সামনে রেখে উপনিবেশি বাস্তবতায় রাজনৈতিক ধর্মতত্ত্ব ( Political Theology) করেন।

لَا يَنۡهٰٮكُمُ اللّٰهُ عَنِ الَّذِيۡنَ لَمۡ يُقَاتِلُوۡكُمۡ فِى الدِّيۡنِ وَلَمۡ يُخۡرِجُوۡكُمۡ مِّنۡ دِيَارِكُمۡ اَنۡ تَبَرُّوۡهُمۡ وَ تُقۡسِطُوۡۤا اِلَيۡهِمۡ​ؕ اِنَّ اللّٰهَ يُحِبُّ الۡمُقۡسِطِيۡنَ‏

অর্থ : "দীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের সাথে যুদ্ধ করেনি, আর তোমাদেরকে তোমাদের ঘর-বাড়ী থেকে বের ক’রে দেয়নি তাদের সঙ্গে সদয় ব্যবহার করতে আর ন্যায়নিষ্ঠ আচরণ করতে আল্লাহ নিষেধ করেন নি। আল্লাহ ন্যায়পরায়ণদেরকে ভালবাসেন।" (৬০:৮)

اِنَّمَا یَنۡهٰىكُمُ اللّٰهُ عَنِ الَّذِیۡنَ قٰتَلُوۡكُمۡ فِی الدِّیۡنِ وَ اَخۡرَجُوۡكُمۡ مِّنۡ دِیَارِكُمۡ وَ ظٰهَرُوۡا عَلٰۤی اِخۡرَاجِكُمۡ اَنۡ تَوَلَّوۡهُمۡ ۚ وَ مَنۡ یَّتَوَلَّهُمۡ فَاُولٰٓئِكَ هُمُ الظّٰلِمُوۡنَ

অর্থ: "আল্লাহ কেবল তাদের সাথেই বন্ধুত্ব করতে নিষেধ করেছেন, যারা দীনের ব্যাপারে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে এবং তোমাদেরকে তোমাদের ঘর-বাড়ী থেকে বের করে দিয়েছে ও তোমাদেরকে বের করে দেয়ার ব্যাপারে সহায়তা করেছে। আর যারা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করে, তারাই তো যালিম।"(৬০:৯)

কোরআনের সুরা মুমতাহিনার ৮-৯ আয়াত ইসলামের এলমি ঐতিহ্যে অমুসলিমের সঙ্গে বন্ধুত্ব ধারণার মূলনীতি হিসেবে বিবেচিত। মুঘল আমলে শাইখ মাসুম আওরঙ্গজেবকে এই মুলনীতি উল্লেখ করেই নসিহত করেন। এই মুলনীতি ব্যবহার করে মওলানা আবুল কালাম আজাদ বলেন, ব্রিটিশ আমাদের খিলাফত আক্রমণ করেছে। হিন্দুরা ইসলাম ও মুসলিমের উপর আক্রমণ করেনি। আল্লাহ বলেছেন যেসব অমুসলিম মুসলিমের উপর আক্রমণ করে না, তাদের সাথে বন্ধুত্ব করতে বাধা নেই। আজাদের মতে,  খিলাফতের সার্বভৌমত্ত্ব রক্ষা মুসলিমের ধর্মীয় জীবনের অংশ। খিলাফতের সার্বভৌমত্ত্ব রক্ষার জন্য অমুসলিমের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে রাজনৈতিক ঐক্য করতে হবে। আজাদ মুমতাহিনায় উল্লেখিত আয়াত দিয়ে ব্রিটিশদের মন্দ অমুসলিম (Bad Non-muslim)  এবং হিন্দুদের ( Good Non-muslim) হিসেবে শনাক্ত করেন। অপরদিকে বেরেলভি মওলানা আহমদ রেযা খান আজাদের এই পাঠের পর্যালোচনা করেন তার “ আল - মাহাজ্জা আল মুতমাআনা ফি আয়াহ মুমতাহানা “ গ্রন্থে। মওলানা আহমদ রেযা খান আজাদের আধুনিক পদ্ধতিতে পাঠকে প্রশ্নবিদ্ধ করেন৷ আহমদ রেযা খান এই আয়াতের পাঠ করেন ইসলামের তুরাস ( Tradition) কে সামনে রেখে। আহমদ রেযা খান অমুসলিমের সঙ্গে বন্ধুত্ব নিয়ে মুমতাহিনার আয়াতের শানে নুযূল পেশ করেন। কুরআনের তফসিরকার হিসাবে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস প্রসিদ্ধ। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসের মতে, মুমতাহিনার আয়াতে “ Those unbelievers who do not fight you on account of your faith and neither drive you forth from you homes. “  বলতে তিন ধারা কে বুঝিয়েছে৷ পয়লা ধারা, যারা মক্কা হতে মদিনায় হিজরত করেনি৷ দুসরা ধারা, বনু খুজা বংশ - যাদের সঙ্গে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম চুক্তি করেছিলেন। শেষ ধারা হলো, অমুসলিমদের ঘরের নারী ও শিশু। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাসের এই তফসির হাজির করে আহমদ রেযা খান প্রশ্ন করে হিন্দুরা কোন ভাবে উপরিক্ত তিন ধারায় পড়ে না। উল্টো মুসলিমের যাপিত জীবনে হিন্দুদের ক্রমাগত আক্রমণের উদাহরণ পেতে গরু কোরবানি ই কাফি। মওলানা আহমদ রেযা খান বন্ধুত্ব বা মুওয়ামালাত দুই ভাগে ভাগ করেন৷ পয়লা অংশের বন্ধুত্ব (Muwalat - i haqiqiyya) যা মহব্বত - অন্তরঙ্গতার বুনিয়াদে হবে। দুসরা অংশ ( Muwalat - o suwariyya) যার ভিত্তি মহব্বত - অন্তরঙ্গতায় হবে না, হবে বাস্তবতার উপর। রাজনৈতিক ধর্মতত্ত্বের বিচারে আহমদ রেযা খান ব্রিটিশ কে (Good Non- muslim) এবং হিন্দুদের (Bad Non-muslim) হিসাবে দোস্তি- দুশমণি চিহ্নিত করেন৷ বাস্তবতার সাপেক্ষে ব্রিটিশদের সঙ্গে Superficial বা Masked Friendship রাখতে বলেন যা (Muwalat - i suwariyya) তে অন্তর্ভুক্ত। আহমেদ রেযা খান শাইখ মাসুমের মতোন বন্ধুত্ব ধারণা নিয়ে অভিন্ন অবস্থান রাখেন৷

গরু কোরবানিকে কেন্দ্র করে বন্ধুত্বের ধারণা কেন্দ্রীয় রুপে হাজির হয়। জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ ফতোয়া দেয় গরু কোরবানি ওয়াজিব নয়। বরং মুবাহ। জমিয়ত গরুর স্থলে অন্য কিছু কোরবানি করার মাধ্যমে অমুসলিমদের সঙ্গে বন্ধুত্বের ভিত্তিতে রাজনৈতিক ঐক্যের মাধ্যমে খিলাফত রক্ষা করতে প্রস্তাব দেয়।  গরু পরিণত হয় বন্ধুত্বের প্রতিজ্ঞায়৷ আহমেদ রেযা খান গরু কোরবানিকে ইসলামের ফিকহের সাপেক্ষে ওয়াজিব বলে ফতোয়া দেন তার, “আনফুসুল ফিকর ফি কুরবানিল বকর” কিতাবে। শের আলি তারিন দেখান আহমেদ রেযা খান মুঘল সালতানাত-উত্তর সার্বভৌমত্ত্বের সংকটে,  মুসলিমের যাপিত জীবনের সাপেক্ষে সার্বভৌমত্ত্ব শনাক্ত করে। যাপিত জীবনেই সার্বভৌমত্ত্ব সংরক্ষিত হয়৷

অপরদিকে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের পক্ষে আব্দুল বারি ফারিঙগী মহলী গরুকে মুসলিমদের প্রতীক নয়, বরং খিলাফত মুসলিমদের প্রতীক দাবি করেন৷ উপনিবেশি এই সময়ে গরু বনাম খিলাফত বাহাস ছিল উভয় সংকটের ন্যায়। কিন্তু এখানে মওলানা আবুল কালাম আজাদ ও আব্দুল বারি ফারিঙগী মহলী বন্ধুত্বের ধারণায় জোর দিচ্ছেন, অপরদিকে আহমেদ রেযা খান ইসলামের ক্ষমতা ও জনপরিসরে ইসলামের সম্মানকে অগ্রাধিকার দেয় যা সার্বভৌমত্ত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত। গান্ধীর নিঃস্বার্থের রাজনীতির ( Politics of Disinterest) প্রভাবে খিলাফত আন্দোলন - উত্তর মুসলিম জনপরিসরে রাজনৈতিক চিন্তা ও তৎপরতা ভিন্ন দিকে প্রবাহিত হয়। মুঘল আমল হতে খিলাফত আন্দোলনে বন্ধুত্বের যে ধারণা হাজিরা দেয়, তা পাকিস্তান আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

৩.(ক) গান্ধীর  নিঃস্বার্থের রাজনীতি, জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের খিলাফত আন্দোলনে চিন্তা-তৎপরতা, খিলাফত আন্দোলনের নাকামিয়াবি, খিলাফত - উত্তর নব্য তুরস্কে কামাল পাশার ক্ষমতা গ্রহন, আইনি বলে ইসলামকে নির্বাসন দেওয়ার পর মুসলিম জনপরিসরে বিশেষত দেওবন্দী ধারায় নয়া রাজনৈতিক কাঠামোর সন্ধান করা হয়। দেওবন্দী ধারা বলতে বিশেষত, আশরাফ আলি থানভি ও তার অনুসারী। খিলাফত-উত্তর দুনিয়ায় থানভি মুসলিমদের রাজনৈতিক কেন্দ্র( Political Markaz) নির্মাণের দিকে নজর দেন। রাজনৈতিক কেন্দ্র ( Political Markaz) নির্মাণে অমুসলিমদের সঙ্গে বন্ধুত্ব ধারণার স্থলে মুসলিম লীগের আধুনিক শিক্ষিত মুসলিমের দিকে নজর দেন৷ পশ্চিমা আধুনিক শিক্ষিত মুসলিমদের নসিহার জন্য থানভি নিজে বই লিখেন। যুক্তির ভিত্তিতে ইসলামের বিভিন্ন বিষয় হাজির করেন৷ তার এই কাজের অনুপ্রেরণা ছিল শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলবি ও তার হুজ্জাত আল বালিগা৷ পশ্চিমা আধুনিক মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে থানভি মুসলিম লীগকে গুরুত্ব দেয়। থানভি অমুসলিমের সঙ্গে রাজনৈতিক ঐক্যের স্থলে ফাসিক মুসলিমের সঙ্গে রাজনৈতিক ঐক্যকে অগ্রাধিকার দেয়। খিলাফত - উত্তর ভারতীয় রাজনৈতিক পরিসরে ফাসিক মুসলিম ও উত্তম অমুসলিম ধারণা হাজির হয়। ১৯৩৭ সনে উত্তর প্রদেশের নির্বাচনে নিয়ে থানভি ফতোয়া দেন, কংগ্রেসের প্রার্থীকে ভোট দেওয়া হারাম৷ মুসলিম লীগ সেই ফতোয়া প্রচার করে। এক মজলিসে থানভি কংগ্রেসের অন্ধত্বের চেয়ে মুসলিম লীগের এক চোখ উত্তম বলে উল্লেখ করেন৷ থানভি বলেন, “ The Muslim League was preferable to the Congress the way a one - eyed man is better than one who is blind. “ থানভির এই তুলনা অক্ষরবাদী বাজারি পাঠে মন্দের ভালো তত্ত্ব দিয়ে বুঝার রেওয়াজ আছে যা থানভির রাজনৈতিক বুনিয়াদ হতে বিচ্ছিম্ন। থানভির রাজনৈতিক উসুল ছিল নসিহা।

আহমদ সিরহিন্দ থেকে তার ছেলে শাইখ মাসুম যেমন নসিহা দিয়েছেন মুঘল যামানায়৷ ঠিক একই তরিকায় থানভি নসিহা দেন পশ্চিমা আধুনিক মুসলিম লীগারদের। মুসলিম লীগের নেতৃত্ত্ব বরাবর থানভি নিজ থেকে চিঠি দিতেন৷ মুসলিম লীগের ইচ্ছায় নয়, বরং নসিহার নিয়তে নানা সময়ে চিঠি দিতেন৷ চিঠির মাধ্যমে এই নসিহতের সিলসিলা শাইখ আহমদ সিরহিন্দ ও তার ছেলে শাইখ মাসুমের সঙ্গে সম্পর্কিত।

কংগ্রেস যখন আইন সভায় মুসলিম নারীদের বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য ধর্ম ত্যাগ করার আইন চালু করেন, তখন থানভি জিন্নাহকে চিঠি দিয়ে ওলামা সমাজের সঙ্গে পরামর্শ করার নসিহত করেন।

থানভির নসিহার রাজনীতি পূর্ণ রুপে ধরা দেয় ১৯৩৮ সনে পাটনায় মুসলিম লীগের অধিবেশনে। পাটনার অধিবেশনে আশরাফ আলি থানভি, জাফর আহমদ উসমানিকে দিয়ে মুসলিম লীগকে নসিহা পাঠান। তিনি মুসলিম লীগকে লস্কর-ই- আল্লাহ ( The Army of Allah) তে পরিণত হবার নসিহত করেন৷ আলি উসমান কাশেমি ও মেগান ইটন রব সম্পাদিত Muslim against Muslim League : Critique of the Idea of Pakistan “ বইয়ে মেগান ইটন রব তার “  Advising the Army of Allah : Ashraf Ali Thanawi's Critique of Muslim League “ বালামে পাটনায় মুসলিম লীগের অধিবেশনে জাফর আহমদ উসমানির মাধ্যমে মুসলিম লীগকে পাঠানো প্রস্তাবনা তুলে ধরেন। থানভির পক্ষ থেকে জাফর আহমদ উসমানি বক্তৃতা পাঠ করেন৷ থানভি শুরুতেই মুসলিম লীগের কল্যাণ কামনা করেন।থানভি বলেন “ In my heart I am with you and I am agreement with the good purpose of the muslim league and I am praying for the progress (tarqi) and wellness ( behebud) of it. “ থানভির প্রথম প্রস্তাব ছিল ইসলামিক পরিচয় নির্মাণ৷ ইসলামিক পরিচয় নির্মাণ করতে মুসলিম লীগকে খোদার সৈন্য বা লস্কর ই আল্লাহ রুপান্তর করতে বলেন৷ “ Only an army organized in the name of Allah- not one organized in the name of nationalism.” থানভি মুসলিম লীগ নেতৃত্ত্বকে ইসলামিক সাজ - সজ্জায় থাকা, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা, রমজানে রোযা রাখা, গরিব মুসলিমদের জাকাত দেওয়ার মাধ্যমে জাকাত আদায় করা এবং রাজনৈতিক কাজে জনগণ কে মসজিদ কেন্দ্রীক করার নসিহত দেন।

হোসাইন আহমদ মাদানির মুত্তাহিদা কওমিয়াত বা এক জাতি তত্ত্ব সামনে রেখে কংগ্রেস প্রচারণা চালায় যে, মুসলীম লীগের সঙ্গে ইসলামের ধর্মতত্ত্বীয় সমর্থণ নেই। ঠিক সেই সময়ে আশরাফ আলি থানভি মুসলিম লীগের রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তি (Political Authority) হবার ধর্মতত্ত্বীয় সমর্থণ দেন৷ থানভির সমর্থণের বুনিয়াদ নসিহা৷ কাশিম জামানের বরাতে, : “ This guardianship also meant providing counsel to the political elite, to ensure that their course of action did not stray too far from the norms of the shari'a. “ জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ থেকে জিন্নাহ কে নিয়ে নানা অপ্রচার করা হয়৷ জিন্নাহ ইসলামিক ব্যক্তিত্ব নয়৷ তাহলে কিভাবে পাকিস্তান আন্দোলনের বৈধতা পায়! পাকিস্তান আন্দোলনের রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তি প্রশ্নের মুখোমুখি হয়। থানভি কুরআনে সুরা বাকারার (২৪৬-২৫১) আয়াতকে সামনে এনে দেখান রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তি ( Political Authority)  ও ধর্মীয় কর্তাব্যক্তি ( Religious Authority) শরিকানা - সংহতির ভিত্তিতে জোট করতে পারে। মুসা আ: এর পরে বনি ইসরাইল গলিতের জুলুম অত্যাচারের শিকার হয়। বনি ইসরাইল আল্লাহর কাছে তাদের জন্য বাদশাহ ( King) পাঠাতে বলে৷ আল্লাহ তালুতকে বাদশাহ হিসাবে পাঠায়৷ তখন বনি ইসরাইল বলে, তালুত কিভাবে বাদশাহ হয়! বাদশাহ হবার হকদার বনি ইসরাইল।

وَ قَالَ لَهُمۡ نَبِیُّهُمۡ اِنَّ اللّٰهَ قَدۡ بَعَثَ لَكُمۡ طَالُوۡتَ مَلِكًا ؕ قَالُوۡۤا اَنّٰی یَكُوۡنُ لَهُ الۡمُلۡكُ عَلَیۡنَا وَ نَحۡنُ اَحَقُّ بِالۡمُلۡكِ مِنۡهُ وَ لَمۡ یُؤۡتَ سَعَۃً مِّنَ الۡمَالِ ؕ قَالَ اِنَّ اللّٰهَ اصۡطَفٰىهُ عَلَیۡكُمۡ وَ زَادَهٗ بَسۡطَۃً فِی الۡعِلۡمِ وَ الۡجِسۡمِ ؕ وَ اللّٰهُ یُؤۡتِیۡ مُلۡكَهٗ مَنۡ یَّشَآءُ ؕ وَ اللّٰهُ وَاسِعٌ عَلِیۡمٌ

অর্থ: “আর তাদেরকে তাদের নবী বলল, নিশ্চয় আল্লাহ তোমাদের জন্য তালূতকে রাজারূপে পাঠিয়েছেন। তারা বলল, ‘আমাদের উপর কীভাবে তার রাজত্ব হবে, অথচ আমরা তার চেয়ে রাজত্বের অধিক হকদার? আর তাকে সম্পদের প্রাচুর্যও দেয়া হয়নি’। সে বলল, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তাকে তোমাদের উপর মনোনীত করেছেন এবং তাকে জ্ঞানে ও দেহে অনেক বাড়িয়ে দিয়েছেন। আর আল্লাহ যাকে চান, তাকে তাঁর রাজত্ব দেন। আর আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ’।”(২:২৪৭)

তালুতের প্রসঙ্গ এনে থানভি দেখান ধর্মীয় কর্তাব্যক্তির রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তি হওয়া জুরুরি নয়। উল্টো শরিকানার মাধ্যমে একে অন্যের পরিপূরক হওয়া যায়। থানভি শুধু নিজে ধর্মতত্ত্বীয় সমর্থণ দিলেন, এমন নয়৷ জাফর আহমদ উসমানিকে উৎসাহিত করলেন৷ থানভির অনুপ্রেরণায় জাফর আহমদ উসমানি হোসাইন আহমদ মাদানির মুত্তাহিদা কওমিয়াতের পর্যালোচনা করেন। কাশিম জামান তার “The Ulema in Contemporary Islam : Custodians of Change “ বইয়ে জাফর আহমদ উসমানির এই কাজকে “Construction of Authority “ বলে চিহ্নিত করেন৷ জামান দেখান জাফর আহমদ উসমানির আগে ইকবাল ও মাওদুদি হোসাইন আহমদ মাদানির মুত্তাহিদা কাওমিয়াতের পর্যালোচনা করলেও, তা ওলামা সমাজে হালে পানি পায়নি৷ যখন জাফর আহমদ উসমানি মাদানির মুত্তাহিদা কওমিয়াতের পর্যালোচনা করেন , তখন স্থানীয় ও বৈশ্বিক ওলামা সমাজ নড়েচড়ে বসেন৷ হোসাইন আহমদ মাদানি তার মুত্তাহিদা কাওমিয়াতে মদিনায় মুসলিম - ইহুদির এক সঙ্গে বাস করার প্রসঙ্গ এনেছেন৷ জাফর আহমদ উসমানি ঠিক এখানেই প্রশ্ন তুলে বলেন, মদিনায় কর্তা আকারে মুসলিম হাজির ছিল। মুসলিমের রাজনৈতিক কর্তা হবার সঙ্গে ক্ষমতার সম্পর্ক৷ মদিনায় ইহুদিরা মুসলিমের এই রাজনৈতিক কর্তা হওয়া মেনে নিয়েছিল যা চুক্তিপত্রের মাধ্যমে কার্যকর হয়। মাদানি গান্ধীর অহিংস আন্দোলনকে নববী মানহায বলে দাবি করেন। জাফর আহমদ উসমানি ছিলেন সিরাত বিশারদ৷ তিনি বলেন, মক্কায় রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবস্থান ছিল ক্ষমতার আরেক স্তরে পৌছানোর, যা পরে মদিনায় বাস্তবায়ন হয়। আশরাফ আলি থানভি - জাফর আহমদ উসমানির মতোন শাব্বির আহমদ উসমানি পাকিস্তান আন্দোলনের গুরুদায়িত্ব তুলে নেন৷ থানভি - জাফর আহমদ এবং শাব্বির আহমদ উসমানি, তিনজন ই গান্ধীর "ইনক্লুসিভ " রাজনীতির বিরোধী ছিলেন৷ শাব্বির আহমদ উসমানি মুত্তাহিদা কওমিয়াতকে দীনি এলাহির সঙ্গে তুলনা করেন। তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে আহবান জানায়, যেরুপ আকবরের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন আহমদ সিরহিন্দ৷ শাব্বির আহমেদ উসমানির বয়ানে : " It is possible that in his (Sirhindi's) revelation there may be a pointer in this direction that when in the future, Muttahida Qaumiyat in another form arise, when Din-i Illahi in the form of Gandhism comes to the fore, it will be Lahore from where the voice for breaking these new idols would issue forth, spread and flourish. "

জিন্নাহ কে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করা হলে, শাব্বির আহমদ উসমানি হানাফি ফিকহ অনুসারে তাকে রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তি হিসেবে ফতোয়া দেন৷ শাব্বির আহমদ উসমানি মুসলিম লীগের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেন হানাফি ফিকহের মশহুর ফকিহ ইবনে হাসান শাইবানির “ আল সিয়ার আল কাবির “ এর মূলনীতিতে ৷ ইমাম শাইবানি ও সহিহ বুখারি - সহিহ মুসলিমের ভিত্তিতে শাব্বির আহমদ উসমানি বলেন, খারেজি এবং অমুসলিম যুদ্ধরত অবস্থায় থাকলে, মুসলিমদের উচিত খারেজিদের সমর্থণ করা। যদিও রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, খারেজিদের হত্যা করতে বলছেন৷ এটা উল্লেখ করে শাব্বির আহমদ উসমানি বলতে চাচ্ছেন, জিন্নাহ বা মুসলিম লীগ ফাসিক৷ আর ফাসিকের সঙ্গে আন্দোলনে ঐক্য করা ফিকহি ভাবে বৈধ। শাব্বির আহমদ উসমানি দেখান হানাফি ফিকহের ইমাম মোহাম্মদ হতে ইমাম আল্লামা ইবনে আবেদিন অমুসলিমের সঙ্গে জোট করার বৈধতা দিয়েছেন, তবে সেখানে মুসলিমদের কর্তা হইতে হবে৷ পাকিস্তান আন্দোলন ই একমাত্র পথ, যেখানে মুসলিম কর্তা হিসাবে আছে। থানভি - উসমানির পাকিস্তান আন্দোলনের বৈধতা দেওয়ার ভিত্তি নসিহা৷ এই নসিহার ভিত্তিতে পাকিস্তান আন্দোলন হয় যার ঐতিহাসিক বাস মুঘল সালতানাতে, যার রাজনৈতিক - সাংস্কৃতিক দিক খিলাফত - উত্তর সময়ে। থানভি - উসমানি ইসলামিক পরিচয় কে গুরুত্ব দিচ্ছেন৷ অমুসলিমের সঙ্গে বন্ধুত্বের ধারনার স্থলে থানভি - উসমানি আত্মসত্তার রাজনীতি প্রস্তাবনা করেন, যেখানে রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তি ফাসিক হলেও সম্যসা নেই৷ অপরদিকে হোসাইন আহমদ মাদানি অমুসলিমের সঙ্গে বন্ধুত্ব ধারণায় জোর দেন৷ যদিও মাদানির অমুসলিমের সঙ্গে বন্ধুত্ব ধারণা আজাদের মতোন নাগরিক বর্গ থেকে নয়৷ মাদানির বাস মুঘল সালতানাতে। মাদানির কাছে আধুনিক ভারত এবং মুঘল হিন্দুস্তান একই। অথচ এই দুইয়ের বিস্তর ফারাক৷ মাদানি পশ্চিমা আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ফাসিক বর্গকে সম্যসাজনক মনে করত। খিলাফত আন্দোলনে আজাদের “ Power is the precondition of Piety “ এর সাথে মাদানি সম্মত হলেও, পাকিস্তান আন্দোলনে কেন থানভি - উসমানির সঙ্গে সম্মত হলেন না? কারন, খিলাফত উত্তর সময়ে ফাসিক মুসলিমদের হাতে ক্ষমতা চলে যাচ্ছিল৷ ফলে মাদানির ট্রমার জন্য তা তিনি মেনে নিতে পারে নাই। মাদানির কিসের ট্রমা? উপনিবেশি ভারতে খিলাফত আন্দোলনের পরেও, খিলাফত রক্ষা করা যায় নাই, উল্টো কামাল পাশা খিলাফত বিলুপ্ত করে ; নব্য তুরস্কে আইনি বলে বি-ইসলামিকরণ করে। জিন্নাহ ও মুসলিম লীগ যখন পাকিস্তান দাবি করে তখন মাদানির সপ্নের জগতে জিন্নাহ কামাল রুপে ধরা দেয়৷ মাদানির এই ট্রমার কারন যৌক্তিক। মাদানির ট্রমার নিশ্চিতি দেয় উপনিবেশি বাংলায় কামালবাদের জয়জয়কার। ফলে ফাসিক জিন্নাহ দমন নীতি মাদানির প্রধান কাজ রুপে হাজির হয়। অপরদিকে থানভি - উসমানি আহমদ সিরহিন্দের সিলসিলা বহাল রেখে ইসলামিক পরিচয় ও নসিহার রাজনীতি করেন৷ হোসাইন আহমদ মাদানি ও আবুল কালাম আজাদ দাবি করবার পরেও, তারা আহমদ সিরহিন্দের সিলসিলা বহন করে না । আহমদ সিরহিন্দের সিলসিলায় ফাসিককে নসিহা দেওয়া অগ্রাধিকার পায়৷ অমুসলিমের সঙ্গে বন্ধুত্ব নয়৷ তড়িঘড়ি করে মাদানি - আজাদ তাদের সিলসিলা শনাক্ত করেছে। তারা আকবর - দারাশিকোর রাজনৈতিক তত্ত্বের ভোক্তা, আহমদ সিরহিন্দ - আওরঙ্গজেবের নয়।

৪. ১৯৪৬ নির্বাচনে আশরাফ আলি থানভি ও শাব্বির আহমদ উসমানির নসিহার রাজনীতির ফল মুসলিম লীগ পায়। ১৯৪৫ সনে শাব্বির আহমদ উসমানি জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ থেকে বের হয়ে জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন। কলকাতায় গড়ের মাঠের অধিবেশনে শাব্বির আহমদ উসমানি তার খুতবায় বলেন : “এ সময়ে পাকিস্তান প্রাপ্তির জন্য মুসলিম লীগকে সম্ভাব্য সকল উপায়ে সাহায্য করা দরকার। কারন লীগ এ নির্বাচনে পরাজিত হলে সুদীর্ঘ কালের জন্য ভারতীয় উপমহাদেশের উন্নতির পথ হয়ে যাবে এবং জাতি হিসাবে তাদের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে৷ এ অবস্থায় মুসলিম লীগকে আসন্ন নির্বাচনে জয়যুক্ত করা সকল মুসলমানদের কর্তব্য।" পাঞ্জাবে ও বাংলার নির্বাচনে লীগ বিপুল ভোটে জয় পায়। সিলেট গণভোটে মওলানা সহুল উসমানি ভাগলপুরি থানভি - শাব্বির আহমদ উসমানি - মুসলিম লীগের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মিলিত হয়ে একমাত্র মুসলিম লীগকে ভোট দেওয়া ওয়াজিব বলে ফতোয়া দেয়৷ সহুল উসমানি ভাগলপুরি বলেন : "পাকিস্তান সংগ্রামে যোগ দেওয়া জুরুরি এবং শরিয়ত মোতাবেক ওয়াজিব এবং কেবল মুসলিম লীগ প্রার্থীকে ভোট দেওয়া একান্ত কর্তব্য।" এভাবে ওলামা সমাজ পাকিস্তান কে নয়া মদিনা হিসাবে গঠন করে যা মুসলিম রাজনৈতিক কর্তাসত্তার সনে সম্পর্কিত৷ সালমান স্যায়িদ দেখাচ্ছেন পাকিস্তান আন্দোলন ছিল কামালবাদের এন্টি থিসিস। স্যায়িদ তার "The meaning of Pakistan " লেখায় দেখান : "The formation of Pakistan was a challenge to Kemalism.  The movement for Pakistan is based on ethnicity or language but rather a politicized Muslim subjectivity. "

কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের পর, শাসনতন্ত্র প্রশ্নে মুসলিম লীগ গড়িমসি শুরু করে। ঠিক এখানে, পূর্বের রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তি ও ধর্মীয় কর্তাব্যক্তির নসিহার ভিত্তিতে যে রিশতা ছিল তার ছেদ ঘটে৷ এই ছেদ ঘটবার কারন কি শুধু বনিবনা না - হওয়া? বা মুসলিম লীগের বিশ্বাসঘাতকা! বাজারি অক্ষরবাদী ইতিহাস পাঠে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন উত্তর সময়ে ওলামা - মুসলিম লীগের স্নায়ু যুদ্ধকে উপরিক্ত শব্দে বাক্সবন্দী করে৷ অথচ কেউ খেয়াল করে না, পাকিস্তানের মতোন আধুনিক রাষ্ট্রে তারা এই প্রথম মুখোমুখি!  ফলে তাদের রাজনীতির যে মূলনীতি তথা নসিহা, তা এই আধুনিক রাষ্ট্রে মুঘল সালতানাত বা উপনিবেশি যামানায় মুসলিম লীগের মতোন ফল দিচ্ছে না ৷ মুঘল সালতানাতে নসিহতে শাসক ন্যায়পরায়ণ হলে, শারিয়া কানুন - জনপরিসর বহাল তবিয়তে থাকত৷ কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রে শাসক মুঘল শাসকের ন্যায় সার্বভৌম নয়। পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের পর,মুসলিম লীগের গড়িমসি ও আধুনিক রাষ্ট্রের অভিজ্ঞতায় নসিহার রাজনীতির কেন্দ্র শাসক হতে রাষ্ট্রের দিকে মোড় নেয়। ফলে পাকিস্তানের সংবিধান সভায় মওলানা শাব্বির আহমদ উসমানি পাকিস্তানকে ইসলামের বুনিয়াদে গঠন করবার প্রস্তাবনা দেয়।

পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের আগে আশরাফ আলি থানভি মনে করতেন, মুসলিম লীগ ফাসিক। মুসলিম লীগের সঙ্গে রিশতার ভিত্তি ছিল নসিহা। আশরাফ আলি থানভির ইন্তেকালের পর শাব্বির আহমদ উসমানি কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেন। তবে নসিহার মূলনীতি বহাল থাকে৷ কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের পর শাসক তথা মুসলিম লীগ হতে নসিহা রাষ্ট্রের দিকে কেন নিলেন? নসিহার মূলনীতি অনুযায়ী মুসলিমের জন্য আলাদা রাষ্ট্র হলে ই যথেষ্ট। শাসক ফাসিক হলেও তার ধর্মতত্ত্বীয় বৈধতা ইসলামের এলমি তুরাসে বিদ্যমান। তাছাড়া মুসলিমের বাস করার জন্য সমাজ রয়েছে। রাষ্ট্র নিয়ে নাক গলানোর হেতু? নসিহার রাজনীতির তাত্ত্বিক - রাজনীতিবিদ কোন জটিলতায় পড়ে রাষ্ট্রের দিকে মোড় নিল! আধুনিক রাষ্ট্র  ইসলামের ইতিহাসের কোন ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা নয়। শুধুই বাস্তবতা। তাহলে রাষ্ট্র এর জুরুরত কেন পড়ছে? আর নসিহার রাজনীতিতে সংকট কই? এই সংকটের লক্ষণ প্রকাশ পায়নি? নাকি এটা  মাদানি - আজাদের চিন্তার যৌক্তিকতার প্রমাণ? 

মাহমুদ মামদানি ইসলামপন্থার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে  উপনিবেশ - উত্তর আধুনিক রাষ্ট্রের ভেতর - বাহিরের সংকট শনাক্ত করে। উপনিবেশ চলে গেলেও, আধুনিক রাষ্ট্রের উছিলায় উপনিবেশিকতার দাগ বহাল তবিয়তে উপস্থিত৷  ফলে ভেতর - বাহিরের এই উভয় সংকট মোকাবিলা করতে নানা সংস্কার ও গঠন জুরুরি হয়ে দাঁড়ায়৷ মামদানির বরাতে, “ contemporary, modern, political Islam developed as a response to colonialism. Colonialism posed a double challenge, external and internal, the challenge of foreign domination and of the need of internal reform to address weaknesses exposed by external aggression." নসিহার রাজনীতি আধুনিক রাষ্ট্রের ভেতর - বাহিরের উভয় সংকট চিহ্নিত করতে পারে নি। অথচ, ইতিহাসের অলিগলি খেয়াল করলে দেখা যায়, সম-সাময়িক আধুনিক ইসলামপন্থার তাত্ত্বিক মওলানা মাওদুদি এই সংকট চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন৷ ফলে মওলানা মাওদুদি পাকিস্তানের শাসন কাঠামো নিয়ে মুসলিম লীগের পর্যালোচনা করেন। হুমাইয়ারা ইক্তেদার দেখান আধুনিক রাষ্ট্রের উপনিবেশি জ্ঞানতত্ত্ব মাওদুদি ইনকার করে। পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের আগে মাওদুদি এই সংকট উল্লেখ করেন তার মাসিক তরজমানুল কোরআনের এক সংখ্যায়৷ মাওদুদির মতে, : “ The question which is of foremost significance to me is whether in this ‘Pakistan ‘ the system of government will based on sovereignty of God or, as per the western democratic principle, the sovereignty of people? In the case of former, it would certainly be Pakistan ; otherwise it will be Napak-istan (land of impure)  “ মাওদুদির বয়ান হতে পাকিস্তানের শাসন কাঠামো সংক্রান্ত যে টীকা চিহ্নিত করা যায়, তাকে আরও বিসদ ভাবে ব্যখ্যার সুযোগ আছে। মাওদুদি কেন এই মন্তব্য করলেন? যেখানে নসিহার রাজনীতির ওলামা সমাজ মুসলিম ভূখন্ড তে নিমরাজি ছিলেন। মাওদুদি উপনিবেশি জ্ঞানতত্ত্ব - আধুনিক রাষ্ট্রের ক্ষমতার রুপ অগ্রীম পাঠ করতে সক্ষম হয়েছিলেন? 

প্রাক আধুনিক সময়ে হতে পাকিস্তান আন্দোলন অবধি নসিহার রাজনীতি ক্ষমতা ব্যবসায় মনোযোগ দেয়নি। নসিহার রাজনীতির ক্ষমতা বিমুখ হবার চিত্র দেখা যায় আশরাফ আলি থানভির বক্তব্যে। থানভি বলেন, : ‘’ It seems that the Leaguers will be successful and whatever( Muslim) state will be established will be governed by those whom we call fasiq awr fajir(big sinners). If through your efforts these (Muslim leaguers) become religious and honest and if they are the ones who govern the state then it is all right. We are not interested in governing a state. Our sole aim is that whatever (Muslim)  State is established that should be in the hands of religious and honest person so that Allah's Din ( Islam) reigns supreme. “ আশরাফ আলি থানভি ও আবুল আলা মাওদুদির চিন্তার কেন্দ্রীয় রুপ ভিন্ন। মাওদুদি ক্ষমতার কেন্দ্র হিসাবে আধুনিক রাষ্ট্র চিহ্নিত করে, অপরদিকে থানভি নসিহার রাজনীতিতে ন্যায়পরায়ণ শাসক৷ আধুনিক রাষ্ট্র এবং প্রাক আধুনিক মুঘল সালতানাতের ক্ষমতার কেবলা ভিন্ন হওয়ায়, মুসলিম লীগের গড়িমসিতে নসিহার রাজনীতির সংকট দেখা যায়।

জর্মান রাজনীতি তাত্ত্বিক ও জুরিস্ট কার্ল শ্মিট তার  “Political Theology : Four Chapters on The Concept of Sovereignty “ তে  আধুনিক রাষ্ট্র ও সার্বভৌমত্ত্ব এর কাঠামো কে ধর্মনিরপেক্ষতার অবয়বে ধর্মতাত্ত্বিক প্রকল্প আকারে শনাক্ত করে৷ খোদা যেরুপ বিধানদাতা, আধুনিক রাষ্ট্র তদ্রূপ আইন প্রয়োগ করে বিধানদাতা হতে চায়৷ এখানে ফারাক নি-ধর্মীয় ছদ্ম অবয়ব। আধুনিক রাষ্ট্র খোদার স্থলে নিজকে প্রতিস্থাপিত করে। শ্মিট দেখান আধুনিক রাষ্ট্রের ধারণা সমূহ ধর্ম হতে এসেছে ( Secularized Theological Concept)। আধুনিক ইসলামপন্থার তাত্ত্বিক মাওদুদির পক্ষে আধুনিক রাষ্ট্র, এর সার্বভৌমত্ত্বের ধরণ, ক্ষমতার নানা মাত্রা বুঝতে পারা যতটা সহজ ছিল, ঠিক ততো জটিল ছিল নসিহার রাজনীতি করা থানভি - উসমানির। কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্র এমন এক বাস্তবতা তৈরি করে, যেখানে থানভি-উসমামির নসিহার রাজনীতি ক্ষমতা কে নয়া তরিকায় মোকাবিলা করেন - যা নসিহার রাজনীতির রুপান্তর। নসিহার রাজনীতির রুপান্তর হয় ঐতিহ্যবাহী ইসলামপন্থায় যেখানে পূর্বের নসিহার রাজনীতির সনে আধুনিক ক্ষমতা পাশাপাশি অবস্থান করে৷ পাকিস্তান রাষ্ট্রে এর নজির দেখতে পাওয়া যায় ঐতিহ্যবাহী ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দল নেজামে ইসলামের মধ্যে।

নসিহার রাজনীতিকে ঐতিহ্যবাহী ইসলামপন্থায় রুপান্তরের পিছনে অনেক আলেম থাকলেও, অন্যতম প্রধান মওলানা আতাহার আলি। ঐতিহ্যবাহী ইসলামপন্থায় রুপান্তরের মাধ্যমে, ওলামা সমাজ পূর্বের নসিহার রাজনীতির সীমাবদ্ধতা হতে মুক্ত হয়। ফলে পাকিস্তানের সংবিধান সভায় ইসলামি শাসনতন্ত্র তৈরির অবজেক্টিভ রেজুলেশনে, সকল ধারার ওলামা সমাজ মিলে ঐতিহাসিক ২২ দফা প্রস্তাবনা দেয়। ঐতিহ্যবাহী ইসলামপন্থী দল নেজামে ইসলাম ১৯৫৪ সনের নির্বাচনে আধুনিক সেক্যুলার ক্ষমতার সঙ্গে যুক্তফ্রন্টে শরিক হয়। নির্বাচনের পর সরকার গঠন করে ক্ষমতার শরিকানা পায়৷ ঐতিহ্যবাহী ইসলামপন্থী দল নেজামে ইসলামের হাত ধরে ১৯৫৬ সনে পাকিস্তানের সংবিধান ইসলামিক রিপাবলিক বা ইসলামি প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়, যেখানে সার্বভৌমত্ত্ব একমাত্র আল্লাহর বলে কবুল করে নেওয়া হয়, যা পাকিস্তানের সংবিধানের অবজেক্টিভ রেজুলেশনে “ Sovereignty over the entire world belongs to Allah Almighty alone and the authority which He has delegated to the state of Pakistan, through its people for being exercised within the limits prescribed by Him is a sacred trust.” লিখিত ৷

 আধুনিক ইসলামপন্থা ও ঐতিহ্যবাহী ইসলামপন্থা ইসলামিক রিপাবলিক পাকিস্তান কে ইসলামিক  আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে গঠন করে, যা আধুনিক কিন্তু সেক্যুলার নয়৷ যেখানে মুসলিম সত্ত্বা ও আধুনিক নাগরিক সত্ত্বা পরস্পরের প্রতিপক্ষ নয়, বরং পরিপূরক৷ থানভি - উসমানির নসিহার রাজনীতি আতাহার আলি ঐতিহ্যবাহী ইসলামপন্থায় রুপান্তরের  মাধ্যমে আধুনিক সেক্যুলার ক্ষমতার মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়। অপরদিকে মাদানি - আজাদের রাজনীতি মুসলিমদের সেক্যুলারকরণ করে ভারতীয় রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে হাজির করে। বাজারি অক্ষরবাদী ইতিহাস পাঠে থানভি - উসমানির সঙ্গে মাদানিকে এক করে দেখা হয় । তাদের দাবি উভয়ই দাওয়াতী পথের পথিক।  অথচ মাদানির সঙ্গে থানভি - উসমানির চিন্তার বুনিয়াদি ফারাক দিব্যলোকের ন্যায় স্পষ্ট।

৫. আহমদ সিরহিন্দ - থানভি - উসমানির নসিহার রাজনীতি ঐতিহ্যবাহী ইসলামপন্থায় রুপান্তরের  সমান্তারালে, নসিহার রাজনীতির বিকারের সুলুকসন্ধান করা জুরুরি। বাজারি অক্ষরবাদী ইতিহাস পাঠে নসিহার রাজনীতি বিকারের লক্ষণ দৃশ্যমান। তবে তার আগে নসিহা, ইসলামপন্থা, সামাজিক আন্দোলন, আধুনিক রাষ্ট্র ও সার্বভৌমত্ত্ব ধারণার নোকতা জুরুরি। উদাহরণ হিসাবে মশহুর নৃততত্ত্ববিদ তালাল আসাদ কে স্মরণ করা যাক৷ তালাল আসাদ তার পিতা মোহাম্মদ আসাদের চিন্তার পর্যালোচনা করেন তার বহুল পঠিত ও সমাদৃত “ Mohammad Asad Between Religion and Politics “ নিবন্ধে। তালাল আসাদ তার পিতা মোহাম্মদ আসাদের উছিলায় আধুনিক রাষ্ট্র, সার্বভৌমত্ত্ব ও ইসলামি রাজনীতি তথা ইসলামপন্থার ব্যবচ্ছেদ করেন৷ তালাল আধুনিক রাষ্ট্রকেন্দ্রিক ক্ষমতার রাজনীতির স্থলে সামাজিক আন্দোলনকে ইসলামি রাজনীতি হিসাবে প্রস্তাব করে, যার ভিত্তি হবে “ সৎ কাজের আদেশ ও অসৎ কাজের নিষেধ। “ তালালের প্রস্তাব মতে, “আমর বিল মারুফ ওয়া নাহি আন আল মুনকার" নামক হুকুমের সম্মিলিত চর্চা ও সম্পাদন (Collective Performance) করা হতে পারে ইসলামি রাজনীতি, যা রাষ্ট্রের হুকুম বা আনুগত্যের সঙ্গে জড়িত হবে না ; ফলে ব্যক্তি তার এথিক্যাল সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এতে সামিল হবে।

তালালের মতে, সামাজিক আন্দোলন হতে পারে প্রান-প্রকৃতির পণ্যকরণ ( Commodification)  এর বিরুদ্ধে লড়াই করা। তালাল তার পিতা হতে ‘শোকর আল মুমিন ‘ ধারণা পান, যেখানে মোহাম্মদ আসাদ মনে করেন দুনিয়াতে খোদা এই প্রান- পরিবেশ -প্রকৃতিকে চিহ্ন হিসাবে তৈরি করেছে ; এর প্রতি মানুষের দায়বদ্ধতা  আছে, যা খোদার প্রতি শোকর গুজারের তরিকা বাতলে দেয় ৷ আধুনিক রাষ্ট্রে ক্ষমতা বাদ দিয়ে তালালের এই সামাজিক আন্দোলন (যাকে তিনি ইসলামি রাজনীতি হিসেবে প্রস্তাব করেন) তা খুব আলোর মুখ দেখবে না৷ আধুনিক রাষ্ট্রের যে নানা মাত্রার ক্ষমতা চর্চা, তাতে ইসলামপন্থীরা ক্ষমতা ছেড়ে অসাধু সিদার্থ হলেও ; ক্ষমতা ইসলামপন্থীদের বোধিবৃক্ষ ছাড়বে না৷ বিশেষত ৯/১১ উত্তর দুনিয়ায় বাংলাদেশের মতোন রাষ্ট্রে ইসলামপন্থার উপর ন্যাক্রো পাওয়ার চর্চা উদাহরণ হিসাবে সতেজ৷ তালাল ইসলামপন্থা বলতে শুধুই আধুনিক ইসলামপন্থাকে বুঝেছেন৷ আহমদ সিরহিন্দ থেকে আশরাফ আলি থানভি - শাব্বির আহমদ উসমানির নসিহার রাজনীতির রুপান্তর যে ঐতিহ্যবাহী ইসলামপন্থা তা তালালের নজরে আসেনি। ঐতিহ্যবাহী ইসলামপন্থা তালাল উল্লেখিত দাওয়াতি - সামাজিক আন্দোলন করলেও, তা রাষ্ট্র ও ক্ষমতা বাদ দেইনি। এমন এক দশা তৈরি করছে যেখানে নসিহা ও ক্ষমতা তালালের চিন্তার মতোন প্রতিপক্ষ নয়। পরিপূরক৷ তালাল ধরেই নিয়েছেন এয়ুরোপীয় আধুনিক রাষ্ট্র তথাস্থ৷ ফলে ব্যক্তি - সমাজের রিশতার সূত্র উল্লেখ করেছেন। কিন্তু আমরা দেখি রাষ্ট্র ও ক্ষমতা ছাড়া সামাজিক পরিসরে “ আমর বিল মারুফ ওয়া নাহি আন আল মুনকার" নামক হুকুমের সম্মিলিত চর্চা ও সম্পাদন (Collective Performance) করা যায় না৷ তালাল যদি খিলাফত উত্তর নব্য তুরস্কে রাষ্ট্রের সাপেক্ষে ভাবতেন তাহলে আরও ভালো হত। কামাল পাশার নব্য তুরস্কে আইনি বলে ইসলামের ক্ষমতায়ন নিষিদ্ধ করা হয়। তুরস্ক রাষ্ট্রে তখন ইসলামপন্থা ছিল না। বদিউজ্জামান সাঈদ নুরসি তালালের দাওয়াত - সামাজিক আন্দোলন করছিলেন, কিন্তু এতে করে কি তুরস্ক রাষ্ট্রের সেক্যুলার ক্ষমতা মুসলিম জনপরিসর - সমাজ - ব্যক্তিকে স্পর্শ করা বন্ধ করে দিয়েছিল? দেয়নি। বন্ধ করে কখনো দিবে না। আধুনিক রাষ্ট্র হরেক রকম ক্ষমতা চর্চা করবেই৷ এটার লাগাম টেনে না ধরে অসাধু সিদার্থ হয়ে বসে থাকলে বোধিবৃক্ষ রক্ষা করে ‘শোকর আল মুমিন ‘ হওয়ার সুযোগ কই?

তালালের মতোন মওলানা আবুল হাসান আলি নদভি ক্ষমতা বাদ দিয়ে দাওয়াতি - সামাজিক আন্দোলনের সম্মিলিত চর্চা করতে বলেন। আধুনিক রাষ্ট্রে ইসলাম প্রতিষ্ঠার তরিকা হিসাবে নদভি মনে করেন শাসককে দাওয়াত দেওয়া তথা নসিহা দেওয়া। নদভি এটাকে আহমদ সিরহিন্দের কৌশল এবং নববী মানহায বলে উল্লেখ করেন৷ তালাল আসাদ এবং আবুল হাসান আলি নদভি আহমদ সিরহিন্দ থেকে থানভি - উসমানি অবধি নসিহার রাজনীতির কুলুজি (Genealogy) হদিস করতেন, তাহলে তাদের চিন্তার পূর্ণতা পেত৷ আবুল হাসান আলি নদভির অভিজ্ঞতা আধুনিক  ভারত৷ ফলত, রাষ্ট্রের সাপেক্ষে তার বিচ্ছিন্নতা প্রকট৷ কারন ইন্ডিক চিন্তার সাপেক্ষে ভারত রাষ্ট্র হিসাবেই ফ্যাসিবাদী যেখানে মুসলিম সত্ত্বার খোজাকরণের মাধ্যমে আধুনিক ভারতীয় নাগরিকে পরিনত হয়। ভারতের স্থলে পাকিস্থান অভিজ্ঞতা নদভির হলে, তিনি নসিহার রাজনীতির রুপান্তর  ঐতিহ্যবাহী ইসলামপন্থাকে আরও যত্ন নিয়ে বুঝতে পারতেন৷ উদাহরণ হিসাবে সিলেটি মওলানা মুশাহিদ বায়ামপুরিকে নেওয়া যায়৷ যিনি মাওলানা হোসাইন আহমদ মাদানির মুরিদ ও ছাত্র। কিন্তু পাকিস্তান বাস্তবতায় তিনিও ঐতিহ্যবাহী ইসলামপন্থার রাজনীতি করেন৷ হোসাইন আহমদ মাদানির ছাত্র ও মুরিদ হবার পরেও মাদানিয়্যতের রাজনীতি তিনি করেনি৷ পাকিস্তানের সংবিধান ইসলাম বান্ধব করণে মুশাহিদ বায়ামপুরির অবদান আছে। মুশাদিদ বায়ামপুরি নসিহতের রাজনীতির নামে যে বিকার তা হতে মুক্ত ছিলেন৷ ভারতীয় ওলামা সমাজের রাজনৈতিক চিন্তার মূলনীতি পাওয়া যায় হোসাইন আহমদ মাদানির “মাকতুবাতে শাইখুল ইসলামে”, যেখানে ‘আহওয়ানুল বালিয়্যাতাইন’ তথা (দুই বিপদের ছোট বিপদ বা কম মন্দ) মূলনীতি হিসাবে বিবেচিত হয়। যদিও হোসাইন আহমদ মাদানি ‘আহওয়ানুল বালিয়্যাতাইন’ কে চূড়ান্ত বলে দাবি করেনি। কিন্তু ভারতীয় এবং বাংলাদেশে তার অনুসারীরা রাজনৈতিক তত্ত্ব হিসাবে তার প্রয়োগ - প্রস্তাব করতে দেখা যায় । এটাকে মাদানিয়্যতের রাজনীতির মূলনীতি হিসাবে শনাক্ত করতে পারি। মাদানিয়্যতের রাজনীতি প্রস্তাব করে রাম রাজত্বের স্থলে সেক্যুলার ভারত। যদিও এটার উসুল একে মঞ্জিল বলে চিহ্নিত করে না৷ কিন্তু মাদানিয়্যত দাবিকারী দের রাজনৈতিক তৎপরতা সেক্যুলার ভারত ও সেক্যুলার বাংলাদেশ বহাল রাখা৷ ফলে মাদানিয়্যত আধুনিক ইসলামপন্থা ও ঐতিহ্যবাহী ইসলামপন্থার রাজনৈতিকতা ও বাসনার বিরোধিতা করে।

নসিহার রাজনীতির রুপান্তররিত সুরুত ঐতিহ্যবাহী ইসলামপন্থায় মুজাদ্দিদে আলফে সানি আহমদ সিরহিন্দ পাকিস্তান আমল হতে বাংলাদেশ আমলে বারে বারে হাজিরা দিয়েছে। অথচ কেউ কেউ আহমদ সিরহিন্দের নাম করে মাদানিয়্যতকে মুজাদ্দিয়াত দাবি করে, যা হাস্যকর বৈকি। পাকিস্তান আমলে ঐতিহ্যবাহী ইসলামপন্থার পুরোধা শামসুল হক ফরিদপুরি লিখেন অসৎ আলেম ও পীর। উক্ত বই নসিহার রাজনীতির সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী ইসলামপন্থাকে এক সূত্রে গাঁথে৷ শামসুল হক ফরিদপুরি এরপর লিখেন ভোটের উসূল ও ভোটারের দায়িত্ব। ঐতিহ্যবাহী ইসলামপন্থার আরেক দিকপাল মুফতি ফজলুল হক আমিনি। মুফতি ফজলুল হক আমিনি মুজাদ্দিদে আলফে সানির সঙ্গে ইসলামপন্থার রিশতা দেখান৷ আমিনির জবানিতে,  “ হযরত মুজাদ্দিদে আলফেসানী (রহ;) দ্বীনের সংস্কারে যে সাহসী ভূমিকা পালন করেন, তা বাস্তবায়নে তিনি কোন সংগঠন গড়ে তোলেননি৷ তার এই 'তাজদীদী' বিশাল কাজ সম্পাদিত হয়েছে একমাত্র "আধ্যাত্মিক" শক্তিবলে। সুতরাং সংগঠনের পূর্বে আমাদের আধ্যাত্মিক বলে বলীয়ান হতে হবে। আমরা সংগঠন করছি, করতে হবে, তাই বলে সংগঠনের মাধ্যমে আমরা সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হব, এমনটি বিশ্বাস করা আদৌ ঠিক নয়। সংগঠনের সঙ্গে সঙ্গে আধ্যাত্মিক শক্তি অর্জন করতে পারলেই হযরত মুজাদ্দিদে আলফেসানীর মত আকবরী ফেতনার মূলোৎপাটন সম্ভব হবে। "

অথচ ইতিহাসের অক্ষরবাদী পাঠের ফলে তৈরি বাজারি বয়ানে মুজাদ্দিদে আলফে সানি আহমদ সিরহিন্দকে ইসলামপন্থার এন্টি থিসিস হিসাবে হাজির করা হয়, যা ইতিহাসের জালিয়াতি বটে। ইতিহাসের জালিয়াতি করা এই বাজারি বয়ানে উল্লেখ করা হয়, তারা সরকার বা প্রশাসনের সঙ্গে নসিহার রিশতা তৈরি করছে। শাসককে নসিহা দেওয়ার মাধ্যমে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করছে। তাদের মতে, শাসক তাহাজ্জুদ গুজারি হলে, তিনি নয়া যামানার আওরঙ্গজেব বা তার বোন রওশন আরা হবেন। মুফতি ফজলুল হক আমিনি এই জালিয়াতি ইতিহাস পাঠ কে প্রশ্নবিদ্ধ করে, একই সাথে যারা এই পাঠ করে তাদের কঠোর ভাষায় নসিহত করেন। মুফতি আমিনির নসিহত :

“আজকাল অনেক মোল্লা মৌলভীই উক্তি করে থাকে যে, মুজাদ্দিদে আলফেসানী (রহ;) যেভাবে শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক রেখে দ্বীনের সংস্কার করেছেন, আমরাও তারই পথ অনুসরণ করে শাসকগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলছি এবং আমরাও সরকারের ইসলাহর জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমি বলব, তারা ইসলাহ নয় বরং সরকারের কাছে তারা বিক্রি হয়ে গেছে।”

প্রাক - আধুনিক সময়ে শাসকের সঙ্গে ওলামা শ্রেণীর রিশতার ভিত্তি ছিল নসিহা, যা ইসলামের এলমি তুরাস হইতে বৈধতা পেত। মুঘল আমলে বিভিন্ন ধারার সুফি সিলসিলা ক্ষমতা কেন্দ্রকে ব্যবহার করে নিজ নিজ তরিকার প্রস্তাবনা - বাসনার প্রয়োগ ঘটাত৷ মুজাদ্দিদি - নক্সাবন্দি তরিকার কেন্দ্রীয় বিষয় শারিয়া। আহমদ সিরহিন্দ হতে তার ছেলে শাইখ মাসুমের বন্ধুত্ব ধারণা, নসিহার মূলনীতি অন্যদের চেয়ে ভিন্ন ছিল। বিশেষত চিশতিয়া তরিকার চেয়ে। মুজাদ্দিদি তরিকার মুখপাত্র রুপে আওরঙ্গজেব হাজির হয়। আওরঙ্গজেবের ইসলামিক পরিচয় কে গুরুত্ব দেয়৷ অপরদিকে দারাশিকো রামের মধ্যে দিয়ে এমন এক রাজনৈতিকতার কল্পনা করে, যেখানে আত্মীকৃত হবার মাধ্যমে পূর্ণতা সম্ভব৷ এই দুই ধারার বাসনা - ভাষা - প্রস্তাব - রাজনৈতিকতার লক্ষণ উপনিবেশি যামানার খিলাফত আন্দোলন এবং শেষে পাকিস্তান আন্দোলনে দেখা যায়৷ আহমদ সিরহিন্দ হতে শাইখ মাসুম হয়ে আশরাফ আলি থানভি - শাব্বির আহমদ উসমানির মাধ্যমে নসিহার রাজনীতি পাকিস্তান আন্দোলনের কেন্দ্রীয় বিষয় হয়। নসিহার রাজনীতির বুনিয়াদে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন হবার পর, আধুনিক রাষ্ট্রের ক্ষমতার বিবেচনায় এর সীমাবদ্ধতা দেখা যায়, যা শাব্বির আহমদ উসমানি - আতাহার আলির মাধ্যমে নসিহার রাজনীতির ঐতিহ্যবাহী ইসলামপন্থায় রুপান্তরের মধ্য দিয়ে, সংকট কাটিয়ে উঠে। আধুনিক ইসলামপন্থার পাশাপাশি ঐতিহ্যবাহী ইসলামপন্থা দৃশ্যপটে হাজির হয়৷ আধুনিক রাষ্ট্র, তার হরেক রকম ক্ষমতার কারিগরি অরাজনৈতিক সামাজিক আন্দোলনকে টিকতে দেয় না৷ আধুনিক রাষ্ট্রের ডিসিপ্লিনারি বা নিয়ন্ত্রণমূলক ক্ষমতা অসাধু সিদার্থ হয়ে উঠবার পথে বাধা। ফলে, আধুনিক রাষ্ট্র এর ক্ষমতার লাগাম টেনে ধরে, তার অহংকার চূর্ণ করে, মুসলিম সত্ত্বা ও নাগরিক সত্ত্বার মধ্যে মীমাংসা করার প্রস্তাবনা দেয় ইসলামপন্থা৷ আধুনিক ইসলামপন্থার পাশাপাশি এ পথের আরেক পথিক ঐতিহ্যবাহী ইসলামপন্থা।

উপনিবেশ শেষ হলেও, উপনিবেশিকতা বহাল তবিয়তে রয়ে গেছে৷ আধুনিক রাষ্ট্রে সেই উপনিবেশিকতার দাগ বর্তমান। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বুনিয়াদি কাঠামোতে ফরাসি - ইংরেজ - ভারতীয় মডেলের উপনিবেশি জাতিরাষ্ট্র বা মার্কিন রিপাবলিকান মডেলের প্রভাব একচ্ছত্র এবং সূদুরপ্রসারী। ফরাসি - মার্কিন - ভারতীয় স্পিরিটকে

সর্বজনীন কল্পনা করে, সাম্য - মানবিক মর্যাদা ভিত্তিক যে রাজনৈতিকতা ও সার্বভৌমত্ত্বের প্রস্তাব করা হয় ; সেই আধিপত্যবাদী জ্ঞানতত্ত্বীয় বাক্সের সমান্তরালে চিন্তা ও তৎপরতার চিহ্ন হিসাবে উক্ত নিবন্ধের সুলুকসন্ধান ৷ রাষ্ট্র সংক্রান্ত চিন্তায় ইউরোপীয় আধুনিক সেক্যুলার জাতিরাষ্ট্র বা রিপাবলিক যে আমাদের একমাত্র মঞ্জিলে মকসুদ না, এর বাইরেও উঁকি দেওয়ার সুযোগ-সম্ভবনা জারি আছে তা স্মরণ করতে ইতিহাসের অলিগলি সন্ধান করবার কোশেশ।

সংবর্ধনা : ঈসায়ী ২৩, চুয়েট সিভিল বিল্ডিং হতে শামসেন হলের সামনে হয়ে ক্যাফেটেরিয়ায় যাওয়ার সময় আমার মুহতারমার সনে ‘হিদায়েতি ‘ নিয়ে গল্প করতে করতে নসিহার রাজনীতি প্রথম মাথায় আসে৷ পরে, চুয়েট ক্যাফেটেরিয়ায় হেমায়েত তৈয়ব এবং  উবাইদুল্লাহ আফজালের সঙ্গে আড্ডায় তা বেগ পায়। বিশেষত হেমায়েত তৈয়বের লাগাতার উস্কানিমূলক প্রশ্ন ও মহব্বতি খোঁচা আমায় জটিলতায় ফেলে, যা আরও ভাবতে সাহায্য করে৷ তরিকুল হুদা ভাইয়ের সঙ্গে দিনের পর দিন আড্ডায় অনুপ্রেরণা ও তত্ত্বীয় রসদ পাই৷ শেষদিকে চাটগাঁ নিবাসী মেহেদী হাসান ভাইয়ের সঙ্গে আড্ডা আমাকে বেশ কিছু পুস্তক দেখতে সাহায্য করে। পাকিস্তানের মহাফেজখানায় যাওয়ার সুযোগ পাইনি। ভারতীয় বাঙালি গবেষক বিশেন্দু নন্দের উছিলায় সর্বভারতীয় মুসলীম লীগের ডকুমেন্টস হাতে পাই। মহিউদ্দিন ভাইয়ের সাথে পাকিস্তান আন্দোলনে ওলামা সমাজের ভূমিকা নিয়ে আড্ডা আমাকে বেশ অনুপ্রেরণা দিয়েছে। স্মরণ করি ভারতীয় বাঙালি ইতিহাসবিদ গৌতম ভদ্রের অনুপ্রেরণামূলক চিঠি। অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খান হতে শব্দের ধার-দেনা কবুল করছি। এছাড়া যেসকল পুস্তক আমি ব্যবহার করেছি, তার বড় অংশের ব্যয় বহন করেন এক মহাত্মা। উপরিক্ত সকলের নিকট আমি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই।

উৎসর্গ :

আশরাফ আলি থানভি (রহ.)

শাব্বির আহমদ উসমানি (রহ.)

আতাহার আলি( রহ.)

দোহাই

১. আল কুরআন, সূরা বাকারা ( ২৪৭) সূরা আল ইমরান - আয়াত : (২৬, ১১০) সুরা মুমতাহিনা - আয়াত :( ৮,৯)

২. ফরিদপুরি, শামসুল হক৷ অসৎ আলেম ও পীর, বিশ্বকল্যাণ পাবলিকেশন, আগস্ট, ২০১১

৩. আমিনী, মুফতী ফললুল হক। দ্বীনে এলাহি : হযরত মুজাদ্দিদে আলফেসানী (রহ.) - এর সংস্কার ; অসৎ আলেম ও পীর ( পাতা - ৮৬) , বিশ্বকল্যাণ পাবলিকেশন, আগস্ট, ২০১১

৪. নদবি, আবুল হাসান আলি। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে ইসলাম কায়েমের কৌশল। বাংলা তর্জমা: মওলবি আশরাফ, আলিমিয়া, বর্ষ ১, সংখ্যা ৩, জুন ২০২৩

৫. খান, সলিমুল্লাহ৷ ইতিহাস ও অজ্ঞান, আবুল খায়ের মোহাম্মদ আতিকুজ্জামান সম্পাদিত, ইতিহাস কারখানা ৩, স্বাধীনতা ব্যবসায়, আগামী প্রকাশনী & এশীয় শিল্প ও সংস্কৃতি সভা, ২০২১

৬. হুদা, তারেকুল। রাষ্ট্রে সার্বভৌমত্ত্ব : তুমি কার, কে তোমার? ভূমিকা : আব্দুর রহমান বারি, মাইলস্টোন জার্নাল, মে, ২০২৪। 

৭. হুদা, তরিকুল৷ তালাল আসাদের মোহাম্মদ আসাদ পর্যালোচনা : ইসলামি রাষ্ট্রে সার্বভৌমত্ত্ব ; তুমি কার, কে তোমার? ফাহমিদ-উর - রহমান সম্পাদিত, মোহাম্মদ আসাদ : বাংলাদেশের অভিবাদন, মক্তব প্রকাশনী, ২০২১

৮. কাউস, কায়। ইতিহাসের ছিন্নপত্র, গার্ডিয়ান প্রকাশনী, ২০২০

৯. আজাদ, আবুল কালাম। মাওলানা আজাদের দৃস্টিতে পাকিস্তান। ভাষান্তর : শফিক আহমেদ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ডিসেম্বর, ২০১০

১০. আব্দুল্লাহ, আবু সাবের। সালাফের পথ ও মাসলাকে দেওবন্দ, আল কাউসার ,বর্ষ - ১৬, সংখ্যা : ০৮, সেপ্টেম্বর, ২০২০

১১. Zaman, Mohammad Qasim. Religion and Politics under Early Abbasids : The Emergence of the Proto - Sunni Elite. Leiden ; New York ; Koln : Brill, 1997

১২. Marlow, Louise. Medieval Muslim Mirrors for Princes. Cambridge University Press, 2023

১৩. Moin, A. Azfar. The Millennial  Sovereign : Sacred Kingship & Sainthood in Islam. Columbia University Press, 2014

১৪. Alam, Muzaffar.  The Mughal and The Sufis : Islam and Political Imagination in India, (1500-1750). Suny Press, 2021

১৫. Devji,Faisal.  Fatal Love : Intimacy and Interest in Indian Political thought . Barkey, Kaviraj and Naresh. Exited book : Negotiating Democracy and Religious Pluralism, , Oxford University Press, 2021

১৬. Metcalf, D Barbara. Islamic Revival in British India Deoband, 1860-1900

১৭. Ambedkar, B.R. Dr. Babasaheb Ambedkar Writings and Speeches. Volume  10.  Education Department, Maharashtra, Pune, India, 1991

১৮. Ambedkar, B.R. What Congress and Gandhi Have Done to the Untouchables. Dr. Babasaheb Ambedkar Writings and Speeches. Vol.9, Education Department, Maharashtra, Pune, India, 1990

১৯. Gandhi, M.K. Hind Swaraj and Other Writings. Cambridge University Press, 2003

২০. Tareen, SherAli. Perilous Intimacies : Debating Hindu - Muslim Friendship After Empire. Foreword by Faisal Devji, Columbia University Press, 2023

২১. Zaman, Muhammad Qasim. Ashraf Ali Thanvi : Islam in Modern South Asia, Oneworld Publication, 2007.

২২.Robb, Megan Eaton. Advising the Army of Allah : Ashraf Ali Thanawi's Critique of Muslim League. Ali Usman Qasmi and Megan Eaton Robb Edited book : Muslim against Muslim League : Critique of the Idea of Pakistan, Cambridge University Press, 2017.

২৩. Zaman, Muhammad Qasim. The Ulama in Contemporary Islam : Custodians of Change. Princeton University Press, 2002.

২৪. Dhulipala, Venkat. Creating A New Medina : State Power ; Islam and the Quest for Pakistan in Late Colonial North India. Cambridge University Press, 2015.

২৫.  Bose, Neilesh. Recasting the Religion : Language, Culture and Islam in Colonial Bengal.

২৬. Friedman, Yohanan. Shaykh Ahmed Sirhindi : An Outline of his Thought and a study of His Image in the Eyes of Posterity, Montreal : McGill University, 1971.

২৭. Habib, Irfan. The Political Role of Shaikh Ahmed Sirhindi and Shah Waliullah. Enquiry, Vol. 5, 1961

২৮.  Mamdani, Mahmood. Good Muslim, Bad Muslim : America, The Cold War and The Roots of Terror,  2002.

২৯. Foundations of Pakistan : All India Muslim League Documents : 1906-1947, Vol 1 PP 44

৩০. Iqtidar & Scharbrodt, Humeira and Oliver . Divine Sovereignty, Morality and the State : Maududi and His Influence, Royal Asiatic Society, Vol.32,  April, 2022

৩১. Asad, Talal. Mohammad Asad Between Religion and Politics,

৩২. Qasimi, Ali Usman. Differentiating Between Pakistan and Napak-istan : Maulana Abul Ala Maududi's Critique of Muslim League and Mohammad Ali Jinnah, Ali Usman Qasmi and Megan Eaton Robb Edited book : Muslim against Muslim League : Critique of the Idea of Pakistan, Cambridge University Press, 2017.

৩৩.Schmitt, Carl. Political Theology : Four Chapter’s on the concept of Sovereignty, Translated George Schwab and Forwarded by Tracy B. Strong, University of Chicago Press, 2005